ফিভার ক্লিনিকে রোগী দেখছেন চিকিৎসক।—ফাইল চিত্র।
জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার সকালে শহরের চার্চ স্ট্রিটের এক মহিলার মৃত্যু হয়েছিল। শুক্রবার ভোরে বেল্টিং বাজারের কাছে একটি নার্সিংহোমে জ্বরে আক্রান্ত এক যুবকও মারা গেলেন। দু’টি ক্ষেত্রেই রোগীর অনুচক্রিকা (প্লেটলেট) নেমে গিয়েছিল যথাক্রমে ৪৫ এবং ২০ হাজারে। তা সত্ত্বেও দু’টি মৃত্যু মৃত্যুই ডেঙ্গির কারণে কিনা, তা ঘোষণা করেননি চিকিৎসকেরা। তবে, এ দিনই স্বাস্থ্য দফতর ঘোষণা করেছে, শ্রীরামপুরে ডেঙ্গি মহামারির আকার নিয়েছে।
এই আতঙ্কের আবহের মধ্যেই সরকারি হিসেবে জানানো হল, শ্রীরামপুর মহকুমায় ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ৪৫০। এর মধ্যে ২২ জনের রক্তের ‘সেরোটাইপিং’ করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৬ জনের শরীরেই মিলেছে ডেঙ্গির সবচেয়ে ভয়াবহ ‘ডেঙ্গ-২’ ভাইরাস।
৭, ৩, ১১, ৮— এই ওয়ার্ডগুলিতেই ডেঙ্গির প্রকোপ বেশি বলে শোনা যাচ্ছিল। ঘটনাচক্রে জ্বরে মৃত দু’জনের মধ্যে রূপা ভট্টাচার্য ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এবং অপর জন গণেশ জানা ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছিলেন।
এ দিন যিনি মারা গেলেন, সেই গণেশবাবুর পরিবারের লোকজনের দাবি, মানুষটি সুস্থই ছিলেন। লিভার বা পেটের গোলমাল ছিল না। গত রবিবার বিকেলে তাঁর জ্বর আসে। তার সঙ্গে মাথায় এবং কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা। রাতেই তাঁকে শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জরুরি বিভাগ থেকে তাঁকে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু জ্বর না কমায় পরের দিন তাঁকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায়, এনএস-১ পজিটিভ। মঙ্গলবার তাঁকে সেখান থেকে শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ডিহাইড্রেশন হয়েছে। সঙ্গে মাথায় সংক্রমণ। ওই হাসপাতাল থেকে বুধবার রাতে তাঁকে এনআরএস হাসপাতালে সরানো হয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গণেশবাবুকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় বিকেলে স্থানীয় নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। গণেশবাবুর দাদা কার্তিকবাবু বলেন, ‘‘সন্ধ্যায় ভাইয়ের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোয়। রক্ত দেওয়া হয়।’’ শুক্রবার ভোরে মারা যান গণেশবাবু। নার্সিংহোমের রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ওই সন্ধ্যায় তাঁর প্লেটলেট ২০ হাজারে নেমে গিয়েছিল। কার্তিকবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমাদের তো মনে হচ্ছে ডেঙ্গিতেই ভাই মারা গেল। ওর শরীরে কোনও রোগই ছিল না। জ্বরটা এসেই সব শেষ করে দিল।’’
আইএমএ-র সদস্য এক চিকিৎসক জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর কাছে জ্বরের চিকিৎসা করাতে আসা এক ব্যক্তির রক্তে ডেঙ্গি ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল। মার্চ মাসে বিষয়টি পুরসভাকে জানানো হয়। জুন মাস থেকে ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়তে থাকে। মুসলমানপাড়া, টিকিয়াপাড়া, নেতাজি সুভাষ অ্যাভিনিউ, রায়ঘাট, বঙ্কিম সরণি, বি পি দে স্ট্রিট-সহ নানা এলাকায় ঘরে ঘরে জ্বরের প্রকোপ বাড়ে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথম দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তেমন গা করেনি বলে অভিযোগ। সেই সুযোগেই ডেঙ্গির ভাইরাস হু হু করে ছড়ায়।
নাগরিকদের একাংশ মনে করছেন, তেল ছড়িয়ে মশার লার্ভা মারা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ভাবে মশা মারার ব্যবস্থা যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ সহজে ডেঙ্গিকে বাগে আনা যাবে না। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরের বক্তব্য, ডেঙ্গির জীবাণু বহনকারী মশা জামাকাপড়ে, জুতোয়, ছাতার মধ্যে বিশ্রাম করে। ফলে এই ধরনের মশা খুঁজে বের করে মারা মুশকিল। সে জন্যই লার্ভা নিধনে জোর দেওয়া হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ মশার কামড় থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে।
সপ্তাহ দু’য়েক আগে অবশ্য প্রশাসন এবং পুরসভা নড়েচড়ে বসে। ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আনতে অভিযান শুরু হয়। ‘ফিভার ক্লিনিক’ খোলা হয়। জলাধারে, নালা-নর্দমায় গাম্বুসিয়া জাতীয় মাছও ছাড়া হয়। যাতে তারা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। মাইকে প্রচার করা হয়। লিফলেট ছড়ানো হয়। বাউল গানের মাধ্যমেও নাগরিকদের সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনও কিছুতেই ডেঙ্গিকে এখনও বাগে আনা যায়নি।
এ দিন ডেঙ্গিকে রাজ্য সরকার মহামারি ঘোষণার পরে কী বলছেন পুরপ্রধান অমিয় মুখোপাধ্যায়?
অমিয়বাবুর দাবি, ‘‘ডেঙ্গি ছড়ানোর পরে আমাদের পরিকাঠামো অনুযায়ী স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করছি। এর পরে স্বাস্থ্য দফতর যা নির্দেশ দেবে, সেই মতো কাজ করা হবে।’’