আটক: ভ্যানের উপর বসেই কেটে যাচ্ছে কিশোরীবেলা। —নিজস্ব চিত্র।
উঠোনের পাশেই পুকুর। তার পাড়ে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো একটা ভ্যান। ভ্যানে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বছর তেরোর মেয়েটা। পায়ে বাঁধা লোহার শিকল!
এ ভাবেই সম্বৎসর খোলা আকাশের নীচে দিন কাটে মূক-বধির মৌমিতা দাসের। পান্ডুয়ার সরাই-তিন্না পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম জগন্নাথপুরে কংক্রিটের রাস্তা ছেড়ে আলপথ বেয়ে খানিক গিয়ে মাটির রাস্তার ধারে তাদের বাড়ি। অভিভাবকরা জানান, ছোট থেকেই মেয়ের ‘মাথা খারাপ’। যার-তার জামাকাপড় টেনে ছিঁড়ে দিত। কামড়ে দিত। তাই শিকলে বাঁধা হয়েছে তাকে।
বাবা গৌতম দাস খেতমজুর। তিনি বলেন, ‘‘এক বছর বয়সের পর থেকেই মেয়ের খিঁচুনি হতো। নিজেই নিজের মাথার চুল ছিঁড়তো। যাকে-তাকে কামড়ে দিত। পান্ডুয়া গ্রামীণ হাসপতালে ওর চিকিৎসা করাই। কলকাতাতেও দেখাই। কোনও লাভ হয়নি।’’
রবিবার সকালে বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, লোহার শিকলে তালা দিয়ে মেয়েটির পা বাঁধা। পরিবারের লোকেরা জানান, স্নান এবং খাওয়ার সময় শিকল খোলা হয়। খাওয়া হয়ে গেলে ফের বাঁধা হয়। রাতে ঘরে নিয়ে গিয়েও একই ব্যবস্থা। গায়ে রোদ পড়লে বা বৃষ্টিতে ভিজলেও যতক্ষণ পর্যন্ত সরানো না হচ্ছে, ততক্ষণ একই ভাবে বসে থাকতে সে বাধ্য হয়।
মেয়েটির জ্যাঠামশাই রতন দাসকে গ্রামের অনেকেই ‘মান্যি’ করেন। তিনি নাকি এ তল্লাটের নামকরা তান্ত্রিক! রতনও ভাইঝির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘ভাইঝির ব্যাপারে মায়ের (মা কালী) সঙ্গে কথা বলেছি। মা বলেছেন, ভাইঝি ঠিক হবে না।’’
এ ভাবে শিকলে বাঁধা থাকায় মেয়েটির একই সঙ্গে শিশুর অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মনে করেন মনোবিদ মোহিত রণদীপ। তিনি বলেন, ‘‘মেয়েটির মানসিক সমস্যা হয় তো রয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে এমন আচরণ চলতে থাকলে সমস্যা আরও জটিল হবে।
মানসিক সমস্যার নির্দিষ্ট চিকিৎসা রয়েছে। যে কোনও জেলা বা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে মনোরোগ বিভাগে যথাযথ চিকিৎসা করানো যেতে পারে। সঙ্গে বাড়ির পরিবেশ এবং পরিবারের সদস্যদের মানসিকতা পরিবর্তনও সমান জরুরি।’’
মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে স্থানীয় পঞ্চায়েত বা প্রশাসনের কী ভূমিকা?
এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য, বিজেপি-র গীতা বাস্কের দাবি, ‘‘এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। খোঁজ নেব।’’ হুবহু একই বক্তব্য পঞ্চায়েত প্রধান, তৃণমূলের সুধাংশু হাঁসদারও। বিডিও (পান্ডুয়া) সাথী চক্রবর্তীও বলেন, ‘‘বিষয়টি জানা ছিল না। আপনার মুখেই শুনলাম। খোঁজ নিয়ে দেখছি কী করা যায়।’’