ফাইল চিত্র।
আতঙ্কের নাম করোনা। তার সঙ্গে মিশছে অজ্ঞতাও। দুয়ের যোগফলে মাঝেমধ্যেই এমন নানা ঘটনা ঘটছে, যা কখনও পারিবারিক বা কখনও সামাজিক বিড়ম্বনার কারণ হচ্ছে। কোপ পড়ছে মানবিক গুণে। প্রশ্ন উঠছে সংবেদনশীলতা নিয়ে।
মাসখানেক আগে রিষড়ার একটি পরিবারের ১২ জনের মধ্যে সাত জনই সংক্রমিত হয়েছিলেন। আক্রান্ত এক মহিলাকে হাসপাতালে পাঠাতে চাননি পরিবারের সদস্যেরা। তখনও ‘সেফ হোম’ বা বাড়িতে চিকিৎসার প্রোটোকল চালু হয়নি। পুর-কর্তৃপক্ষের কাছে পরিবারের লোকেরা আর্জি জানান, মহিলা চলে গেলে বাড়িতে রান্না করার কেউ থাকবে না। পরিবারের কথা ভেবে মহিলাও একই অনুরোধ জানান। পুর-আধিকারিকরা কয়েকটা দিন তাঁদের সকলকে রান্না সামলে নেওয়ার পরামর্শ দেন। পুলিশও বোঝায়। তা শুনে বাড়ির লোক রণে ভঙ্গ দেন। মহিলা-সহ অন্য সংক্রমিতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখন সবাই সুস্থ। সংক্রমিত হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি কোন্নগরের এক দম্পতি। বাড়িতে ১২ বছরের ছেলেকে দু’দিন একাই থাকতে হয়েছিল। কেউ সঙ্গ দেননি। তৃতীয় দিনের মাথায় একটু সুস্থ হতে তার মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি শ্রীরামপুরের এক বৃদ্ধা কোভিড হাসপাতালে মারা যান। হাসপাতালের তরফে পরিজনদের দেহ দেখতে আসতে বলা হয়। তাঁরা জানান, পারিবারিক কারণে যেতে পারবেন না। মাসখানেক আগে মৃত এক বৃদ্ধের পরিবারের লোকেরাও শেষ দেখা দেখতে যাননি। মরদেহের ছবি পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।রিষড়ার ঘটনাকে অনেকেই মহিলার প্রতি পরিবারের গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি বলে মনে করছেন। মনোবিদ মোহিত রণদীপের কথায়, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই মহিলাকে বাড়ির কাজের লোক মনে করা হয়। এখানেও সেই চিন্তাভাবনাই ফুটে উঠছিল। বাড়ির অত লোক প্রথমেই খাবারের বিকল্প ব্যবস্থা করার কথা ভাবলেন না কেন?’’
রিষড়া পুরসভার করোনা সংক্রান্ত নোডাল অফিসার অসিতাভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পরিবার হল সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট। করোনা বিপর্যয় প্রথমে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে আক্রমণ করছে। তাতেই বিভিন্ন রকম বিচিত্র পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তবে, সমস্যা ক্রমে কমছে। সচেতনতা বাড়ছে। সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে এটাই এখন মূল অস্ত্র।’’সমাজবিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের একাংশের মতে, মানুষের মধ্যে থাকা স্বার্থপরতা করোনা পরিস্থিতিতে নানা ক্ষেত্রে প্রকট হচ্ছে। সংক্রমণের আতঙ্ক এই স্বার্থপরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তবে, কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হওয়ার ঘটনাও চারপাশে ঘটছে। করোনা রোগীদের সাহায্যে অনেকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসছেন।
শ্রীরামপুরের বাসিন্দা, পূর্ব বর্ধমানের কালনা গভর্নমেন্ট কলেজের এডুকেশন বিষয়ের শিক্ষিকা রাখি ভট্টাচার্য মনে করেন, ‘‘রোগটা যেহেতু একেবারে আলাদা এবং নতুন, তাই অজ্ঞতা এবং ভয় মনে জাঁকিয়ে বসছে। তা থেকেই এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যা মানবিক গুণাবলির সঙ্গে খাপ খায় না। তবে, পরিস্থিতি বিচার না-করে কারও দিকে আঙুল তোলা বোধহয় ঠিক নয়।’’