ব্যবসায়ী থেকে নেতা হয়ে ওঠা কুন্তলকে কী ভাবে চেনেন তাঁর প্রতিবেশীরা? জানালেন তাঁরা। ছবি: পিটিআই।
শিক্ষক নিয়োগে বেনিয়মের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন আরও এক তৃণমূল নেতা। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে শনিবার কুন্তল ঘোষকে গ্রেফতার করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। কিন্তু ওই যুবকের গ্রেফতারিতে অবাক তাঁর প্রতিবেশীরা। কারণ, এলাকাবাসী তাঁকে চিনতেন সকলের পাশে দাঁড়ানো, ডাকলেই কাছে-পাওয়া এক যুবক হিসাবে। এলাকায় ‘প্রভাবশালী’ ছিলেন বটে। তবে গ্রামে দানধ্যানেও বেশ নাম রয়েছে এই তৃণমূল নেতার।
কুন্তলের বাড়ি হুগলির শ্রীপুর বলাগড় গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। বাবা স্বপন ঘোষ ছিলেন সিপিএম নেতা। এলাকায় বেশ পরিচিত তিনি। কুন্তল ছাত্রাবস্থায় কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলেই খবর। ২০১১ সালে ধনেখালিতে একটি বিএড কলেজ খোলেন তিনি। তবে এটা ছিল তাঁর অংশীদারি ব্যবসা। অর্থাৎ, একাধিক মালিক ওই কলেজের।
ব্যবসায়ী কুন্তলের রাজনৈতিক যোগ ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে। তখন বলাগড় বিধানসভা এলাকায় তৃণমূলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যেত তাঁকে। কলকাতায় শাসক দলের সমস্ত কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে দেখা যেত কুন্তলকে। তৃণমূলের একটি সূত্র অনুযায়ী, দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন তাঁকে। সায়নী ঘোষের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক। এর ফলেই তৃণমূলের যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পান। তা ছাড়াও, রাজ্যের হ্যান্ডবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পান। শুধু হুগলি জেলাই নয়, বাইরের বেশ কিছু জেলাতে কুন্তলের একাধিক বিএড কলেজ আছে বলে খবর। বলাগড়ের জিরাটে ছোটদের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেরও অন্যতম মালিকানা ছিল তাঁর নামে।
এই সুবাদেই মানিক ভট্টাচার্য-‘ঘনিষ্ঠ’ বিএড কলেজ সংগঠনের সভাপতি তাপস মণ্ডলের সঙ্গে পরিচয় হয় কুন্তলের। সেই তাপসই নাকি তদন্তকারীদের কাছে জানিয়েছেন, শিক্ষক নিয়োগের নামে ১৯ কোটি টাকা কুন্তলের কাছে গিয়েছে। যদিও সিবিআই সূত্রে এই দাবির সমর্থন মেলেনি। তবে তাপসকে তিন বার সিজিও কমপ্লেক্সে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর চিনার পার্কের একটি আবাসন থেকে কুন্তলকে গ্রেফতার করেছে ইডি।
স্থানীয়েরা বলছেন, হালে বলাগড়ে আসা-যাওয়া কমে এসেছিল কুন্তলের। পৈতৃক বাড়িতেও তাঁকে খুব একটা দেখা যেত না। বেশির ভাগ সময় কলকাতায় থাকতেন। প্রতিবেশীদের তেমনই দাবি। মালবিকা রায় নামে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘‘কুন্তলকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। গ্রামে খুব দানধ্যান করত। কারও বিয়ে, কারও বাড়িতে কেউ মারা গেলে পাশে দাঁড়াত ও। ওর বাবা স্বপন ঘোষও সকলকে খুব সাহায্য করতেন।’’ তাঁর সংযুক্তি, ‘‘কুন্তলের বাবা তো শ্রীপুর-বলাগড় পঞ্চায়েতে সিপিএমের প্রধানও ছিলেন।’’
এখন পৈতৃক বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্বে এক জন ‘কেয়ারটেকার’ রেখেছেন। তা ছাড়া, তিনটি পোষ্যকে দেখভালের জন্য এক জন লোক এবং বাড়িতে নিত্য পুজোআর্চার জন্য এক জন পুরোহিত প্রতি দিন আসতেন বলে জানাচ্ছেন প্রতিবেশীরাই।
বাড়ির ‘কেয়ারটেকার’ দীপক বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রতি দিন এক বার করে এসে বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিই। কুন্তলবাবু মাঝেমাঝে পরিবার নিয়ে আসতেন। পরিবার নিয়ে এলে সারা দিন বাড়িতে থাকতেন।’’ তাঁর মাইনে ১০ হাজার টাকা বলে জানান দীপক। তিনিই জানান, আরও দু’জন বাড়িতে কাজ করতেন। তাঁদেরও মাসে মাসে পারিশ্রমিক পাঠিয়ে দিতেন কুন্তল।
সেই কুন্তল নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হয়েছেন শুনে মালবিকা ও অন্য প্রতিবেশীরা অবাক। বিস্ময়ের সুরে মালবিকা বলেন, ‘‘কিছু দিন আগেই তো কুন্তল এই বাড়িতে এসেছিল পরিবার নিয়ে। পাড়ার সবাই মিলে পৌষ মাসে পিকনিক হল।’’
গিরীশ বিশ্বাস নামে আর এক প্রতিবেশী বলেন, ‘‘কুন্তলের বাবাকে চিনতাম। ভাল লোক ছিলেন। ওঁদের একটা সারের দোকান ছিল। অ্যালুমিনিয়ামের কারখানাও ছিল। সচ্ছল পরিবার। তবে কুন্তল যদি অপরাধ করে থাকে, শাস্তি হোক।’’
কুন্তলকে নিয়ে জেলা তৃণমূল এই মুহূর্তে কিছু বলতে নারাজ, তবে সিপিএম জেলা কমিটির সদস্য অতনু ঘোষ বলেন, ‘‘স্বপন ঘোষ শ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন। কুন্তল তখন ছোট। আর বড় হয়ে তৃণমূল রাজনীতি করা মানে টাকার উপায় করা। কারণ, তৃণমূল আর দুর্নীতি সমার্থক।’’ সিপিএম নেতার সংযুক্তি, ‘‘বলাগড়ে শুধু কুন্তল নন, তাঁর মতো আরও অনেকে আছেন। আমাদের লড়াই একা কুন্তলের বিরুদ্ধে নয়। দুর্নীতি আর দুর্নীতিগ্রস্তের বিরুদ্ধে।’’