প্রমথেশ ঘোষালের হাতে বাবা-মা এবং বোনের খুনের ঘটনায় হতবাক হুগলির ধনেখালির দশঘড়া গ্রাম। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
প্রথমে ভারী বস্তু দিয়ে মাথায় আঘাত, তার পর হাতের শিরা কেটে খুন। প্রমথেশ ঘোষালের হাতে বাবা-মা এবং বোনের খুনের ঘটনায় হতবাক হুগলির ধনেখালির দশঘড়া গ্রাম। অঙ্কের গৃহশিক্ষক হিসাবে পাড়ায় বেশ নামডাক প্রমথেশের। তাঁর মতো এক জন মেধাবী ভাল মানুষ কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একেবারে পেশাদার খুনিদের মতো পরিকল্পনা করে নিজের বাবা-মা ও বোনকে নৃশংস ভাবে খুন করলেন, তা এখনও ভেবে পাচ্ছে না দশঘড়ার রায়পাড়া।
পরিবারের তিন সদস্যকে খুন, তার পর প্রমথেশের আত্মহত্যার চেষ্টা— মঙ্গলবার সকালে এই খবর এলাকায় চাউর হতেই শ’য়ে শ’য়ে মানুষ এসে জড়ো হয়েছিলেন রায় বাড়়ির সামনে। ওই বাড়িতে গত ৪০ বছর ধরে রয়েছে ঘোষাল পরিবার। ঘটনার তদন্তে নেমে পরিবারের বাকি লোকজনদের থেকে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, প্রমথেশের বাবা অসীম ঘোষাল আগে তারকেশ্বরে থাকতেন। শিল্পী মানুষ ছিলেন। দশঘড়ায় সাইনবোর্ড লেখার একটি দোকান ছিল তাঁর। বেহিসাবি জীবনযাপন নিয়ে বাড়িতে বাবার সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় দশঘড়ায় রায়দের জমিদারবাড়িতে ভাড়া চলে আসেন তিনি।
প্রমথেশ জন্ম থেকেই দশঘড়ায় রয়েছেন। দশঘরা হাই স্কুল থেকে পাশ করে বিজ্ঞানে স্নাতক। তার পর কলকাতায় পড়াশোনা। কিন্তু চাকরি পাননি। তাঁর জেঠতুতো বোন অরুণীতা রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘দাদাকে আমার বাবা কলকাতার ভর্তি করে দেয়। তার পর চাকরি না পেয়ে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে ও। অঙ্ক-বিজ্ঞান খুব ভাল পড়াত। অনেক ছাত্র পড়তে আসত ওঁর কাছে। মাস গেলে মোটা টাকা আয়ও করত। কোনও সমস্যা ছিল না।’’ প্রমথেশের বন্ধু জগদীশ হাইতের কথায়, ‘‘এত ভাল পড়াত প্রমথেশ! ওঁর কাছে আমার মেয়েও পড়েছে। ভাল ছেলে, ভাল মাস্টার হিসাবে ও এক নম্বর ছিল দশঘড়ায়। সেই ছেলে এমন কাণ্ড ঘটাবে ভাবতেই পারছি না।’’
মঙ্গলবার সকালে প্রতিবেশীরা ঘরে ঢুকে দেখেছিলেন, দরজার পাশে পড়ে রয়েছে প্রমথেশের দেহ। বাবা-মায়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ মেঝেতে আর পাশের ঘরের খাটে পল্লবী। তদন্তকারীদের ধারণা, দুম করে এই কাণ্ড ঘটিয়ে বসেনি প্রমথেশ। অর্থকষ্টের মধ্যে বাবা-মায়ের ওষুধের খরচ আর নিজের লিভারের জটিল অসুখ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই টানাপড়েনে ছিলেন তিনি। জগদীশও বলেন, ‘‘সব গুনের মধ্যে একটা দোষ ছিল প্রমথেশের। ভীষণ নেশা করত।’’
আত্মীয় ও বন্ধুদের দাবি, সম্ভবত মদের নেশা থেকে কঠিন লিভারের অসুখ বাঁধিয়েছিলেন প্রমথেশ। বছর দুয়েক আগে কলকাতার একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন। তার পরও ঠিক না হওয়ায় চিকিৎসার জন্য চেন্নাইতে গিয়েছিলেন তিনি।
তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ওষুধের জন্যই মাস গেলে ৩০ হাজার টাকা খরচ হত প্রমথেশের। সুস্থ ছিলেন না বোন পল্লবীও। বছর দশেক আগে পূর্ব বর্ধমানের জৌ গ্রামে বোনের বিয়ে হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতিতে একেই উপার্জন কমে আসে প্রমথেশের। তার উপর পল্লবীকেও অর্থ সাহায্য করতে হত। বাবাও রোজ মদ খাওয়ার টাকা চাইতেন। যা নিয়ে সংসারে অশান্তি নিত্য ঘটনা।
প্রমথেশ নিজেও পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁর পক্ষে বাবা-মা ও বোনের বোঝা আর টানা সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর কিছু হয়ে গেলে বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখবে কে, এই চিন্তাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল প্রমথেশকে। তাই লহমায় সব শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সত্যিই মানসিক অবসাদ না কি খুনের পিছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতের আবেদন করে বুধবার প্রমথেশকে চুঁচুড়া আদালতে তোলে ধনেখালি থানার পুলিশ।