শিশুকে কোলে নিয়ে মা ইয়াসমিনা বেগম। নিজস্ব চিত্র
দু’মাস ধরে লড়লেন বটে ইয়াসমিনা বেগম!
উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালের চার শিশু চিকিৎসকও (রাজা প্রামাণিক, শান্তনু ভট্টাচার্য, শেখ আবুল আশিক এবং দিব্যাংশু বাগুই) কম গেলেন না। তাঁরাও যুদ্ধ করলেন সমান তালে।
এই মিলিত লড়াইয়ে অসম্ভবও সম্ভব হল। বেঁচে গেল নির্দিষ্ট সময়ের ১৪ সপ্তাহ আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া ইয়াসমিনার কন্যাসন্তান। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ৭০০ গ্রাম। আর এখন ১ কেজি ৩৬৫ গ্রাম ওজনের হয়ে যাওয়া সেই সন্তানকেই কোলে নিয়ে ইয়াসমিনা বুধবার বাড়ি ফিরলেন।
লড়াইটা যে প্রায় অসম্ভব ছিল, তা মানছেন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। কারণ, শিশুটিকে প্রথম চার দিন কিছু খাওয়াতেই পারেননি তাঁরা। পঞ্চম দিনের মাথায় নল দিয়ে খাওয়ানো শুরু হয়। তারপর?
শিশু চিকিৎসক রাজা জানান, এই ধরনের শিশুর ক্ষেত্রে দু’টি বড় সমস্যা হল দ্রুত তাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা এবং মায়ের সংস্পর্শে বেশি করে রাখা। মায়ের সংস্পর্শে রাখার ডাক্তারি পরিভাষা হল ‘কেএমসি’ বা ‘কাঙ্গারু মাদার কেয়ার’। অর্থাৎ, ক্যাঙ্গারু যে ভাবে নিজের পেটের থলিতে সন্তানকে দীর্ঘক্ষণ রেখে দিতে পারে,
‘কেএমসি’ পদ্ধতিতে মাকেও দীর্ঘক্ষণ শিশুকে বুকে জড়িয়ে রাখতে হয়। কিছুক্ষণ করে বিরতি দিয়ে এক এক দফায় টানা দেড় ঘণ্টা ধরে। এই শিশুটির মা ধৈর্যের সঙ্গে তা দিনের পর দিন করেছেন।
ওই শিশু চিকিৎসক বলেন, ‘‘কয়েক মিনিটের বিরতি দিয়ে দিনে ১০ ঘণ্টা ধরে ইয়াসমিনা তাঁর সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন।’’ হাসপাতালের সুপার সুদীপরঞ্জন কাঁড়ার বলেন, ‘‘২০১২ সালে হাসপাতালে এসএনসিইউ (অসুস্থ সদ্যোজাতদের পরিচর্যা কেন্দ্র) চালু হওয়ার পর থেকে কয়েক হাজার শিশুর চিকিৎসা হয়েছে। এত কম ওজনের অসুস্থ শিশুকে এই প্রথম আমরা ভর্তি করালাম। শিশুটিকে সুস্থ করার চ্যালেঞ্জ নিলাম। নার্সরা সমানতালে লড়াই করেছেন। এটা সকলের সম্মীলিত প্রচেষ্টা।’’
গত ১৮ জুন প্রসব বেদনা ওঠায় কুলাই ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ইয়াসমিনাকে। তিনি পথে অ্যাম্বুল্যান্সেই প্রসব করেন। কিন্তু নামমাত্র ওজনের শিশুকে কোলে নিতে সাহস পাননি। কোনওমতে কাপড়ে মুড়ে সদ্যোজাতকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে ‘রেফার’ করেন।
মহকুমা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও শিশুটিকে ভর্তি করাতে প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ, এসএনসিইউ-তে অত কম ওজনের শিশুর চিকিৎসার পরিকাঠামোগত অভাব নেই। তাঁরা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করেন। কিন্তু অর্থাভাবের কথা জানিয়ে শিশুটির বাবা-মা সেখানে সন্তানকে নিয়ে যেতে বেঁকে বসেন। মহকুমা হাসপাতালেই ভর্তির জন্য তাঁদের আকুল আবেদনে সাড়া দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
মহকুমা হাসপাতালের এসএনসিইউ-তে ভর্তির পরে চার শিশু বিশেষজ্ঞকে নিয়ে বিশেষ দল তৈরি করা হয়। সেই দলের সদস্যেরা দিন রাত এক করে শিশুটির পরিচর্যা এবং চিকিৎসা চালাতে থাকেন। তাঁরা জানান, এই ধরনের শিশুদের চোখের সমস্যাও দেখা দেয়। হাসপাতালের চক্ষু চিকিৎসক বিজন মল্লিক কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধীন ‘রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমজি’-র পরামর্শ নিয়ে শিশুটির চোখের সমস্যা যাতে না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখেন।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, এ ভাবে চলতে চলতে দেখা যায়, শিশুটির ওজন বাড়ছে। সে এখন মায়ের বুকের দুধ খেতে পারছে। রাজা বলেন, ‘‘শিশুটি পুরোপুরি স্বাভাবিক ও বিপন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই তাকে আমরা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। অবশ্য বাড়িতে যাওয়ার পরেও এক বছর ধরে সে আমাদের চিকিৎসাধীনেই থাকবে।’’
এ দিন শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছিলেন তার বাবা, ঠাকুমা, দিদিমা। হাসপাতাল থেকে বেরোনর সময়ে শিশুটিকে কোলে নিয়ে ইয়াসমিনা বলেন, ‘‘মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে সব কষ্ট হাসিমুখে সয়েছি। জন্মের সময় ওকে ভয়ে কোলে নিতে পারিনি। এখন মেয়ে আমার কোল আলো করে শুয়ে আছে।’’
হাওড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিতাইচন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘‘এতদিন পর্যন্ত এই জেলার কোনও হাসপাতালে এত কম ওজনের শিশুর চিকিৎসা হয়নি। এটা মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিশেষ কৃতিত্ব।’’