শ্যামনাথ পান্ডে। নিজস্ব চিত্র।
লড়াইটা সহজ ছিল না।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে শরীরে ব্লাড ক্যানসারের হানা। বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন। বহুবার কেমোথেরাপি। পড়াশোনায় বারবার ছেদ। তবু, বারবার পড়ার টেবিলেই ফেরা। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে এর সঙ্গে জুড়ল যকৃতে (লিভার) কঠিন সংক্রমণ। তবু হার মানতে চাননি তিনি। অসুস্থতা নিয়েই হাসপাতাল-ঘর করতে করতে সাঁকরাইলের ধূলাগড়ির শ্যামনাথ পাণ্ডে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেন ৪৪২ নম্বর নিয়ে।
পাঁচলার গঙ্গাধরপুর বিদ্যামন্দিরের ওই ছাত্রের জেদ দেখে সকলে অবাক। শ্যামনাথ চান আইনজীবী হতে। আইনের কলেজে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়াও শুরু করে দিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে প্রত্যয়, ‘‘আইন পেশা অনেক চ্যালেঞ্জের, তা মানি। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও উচ্চ মাধ্যমিকের ভাল ফল আমাকে চ্যালেঞ্জ নিতে শিখিয়েছে। সফল আমি হবই।’’ ছেলের পরীক্ষার ফলে সব কষ্ট ভুলেছেন শ্যামনাথের বাবা আশিস পাণ্ডে। একটি মনিহারি জিনিসের দোকান চালিয়ে, সামান্য রোজগারে ছেলের পর পর দু’টি কঠিন রোগের চিকিৎসা করানো সহজ ছিল না। সাহায্য পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু এখনও চিকিৎসার খরচ সামলাতে নাজেহাল হচ্ছেন। তবু, তাঁর কণ্ঠে প্রশান্তি, ‘‘মুম্বইয়ের যে হাসপাতালে ছেলের ক্যানসারের চিকিৎসা হয়েছে, সেখানে খরচের সিংহভাগ জুগিয়েছে একটি ট্রাস্ট। বোন ম্যারো দিয়েছে আমার বড় ছেলে। তবুও আমি চিকিৎসা খরচ জোগাতে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছি। কিন্তু ছেলের পরীক্ষার ফল দেখে সব কষ্ট ভুলে গিয়েছি।"
শ্যামনাথের যখন ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে, তখন তিনি জুজারশাহা পি এন মান্না হাই স্কুলের ছাত্র। তাঁকে মুম্বইয়ের হাসপাতালে দেড় বছরেরও বেশি সময় ভর্তি থাকতে হয়। বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন এবং বহুবার কেমোথেরাপি নিয়ে তিনি কিছুটা সুস্থ হন। কিন্তু ততদিনে স্কুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। সুস্থ হয়ে ফিরে তিনি ফের পড়াশোনা শুরু করতে চান। পুরনো স্কুল তাঁকে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ শংসাপত্র দেয়। সেটি নিয়ে শ্যামনাথ বাড়ির কাছের ধূলাগড়ি আদর্শ বিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি দশম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিছুদিনের মধ্যেই লিভার সংক্রমণ।
লিভার সংক্রমণের চিকিৎসা ও ব্লাড ক্যানসারের চেকআপের জন্য তখন দু’মাস অন্তর মুম্বই যেতে হচ্ছিল তাঁকে। পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। তার মধ্যেও তিনি ৭০ শতাংশ নম্বর নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন গঙ্গাধরপুর বিদ্যামন্দিরে। মাধ্যমিকের পর থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁকে ছ’মাস অন্তর মুম্বই যেতে হয় চিকিৎসার জন্য।
খেতে হয় প্রচুর ওষুধ। বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়। তবু,
এই নিয়মের মধ্যেই পড়াশোনা করে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে শ্যামনাথের বাংলায় প্রাপ্তি ৭৭, ইংরেজিতে ৮০, ইতিহাসে ৯৪, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৯৮ এবং ফিজিক্যাল এডুকেশনে ৯৩।
দাদা রামনাথের কথায়, "ইতিহাস আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জন্য ভাইয়ের একজন গৃহশিক্ষক রেখেছিলাম। বাংলা আর ইংরেজি পড়িয়েছেন ওর স্কুলের শিক্ষকেরাই। এ ছাড়াও স্কুল যে ভাবে ওরল পাশে ছিল, ভুলব না।" সদ্য অবসর নেওয়া গঙ্গাধরপুর বিদ্যামন্দিরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শঙ্কর খাঁড়া বলেন, "ছাত্রটির সব কথা জানার পরে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করানোর সময়েই চ্যালেঞ্জ নিই, ওর পাশে দাঁড়িয়ে ভাল ফল করাতেই হবে। ও নিয়মিত স্কুলে আসতে পারত না। তার জন্য যাতে রেজিস্ট্রেশনে কোনও সমস্যা না হয়, তা দেখা থেকে শুরু করে পঠনপাঠনে সব দিক থেকে সহায়তা করেছি। ছাত্রটির জেদ দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছি।’’
জেদকে সম্বল করেই এ বার আইনজীবী হওয়ার লড়াই শুরু শ্যামনাথের।