কাজে ব্যস্ত চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা। ছবি: তাপস ঘোষ।
শোভাযাত্রা হবে কি না, ঠিক নেই। না হলেও চন্দনননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো এ বার আরও আলোকময় হতে চলেছে। পথের আলোকসজ্জার জন্য এ বারই প্রথম পুরস্কার ঘোষণা করেছে শহরের কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটি।
দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো পার। জগদ্ধাত্রী পুজো আসছে। চন্দননগরের আলোর কারখানাগুলির চেনা ব্যস্ততা উধাও। করোনা আবহে গত বছর যে আঁধার নেমেছে এখানকার আলোকশিল্পে, তা এখনও আলোর পথ দেখেনি। বহু কারিগর কাজ হারিয়ে বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ করছেন। শিল্পীদের একাংশও আলোর সঙ্গে অন্য ব্যবসা ধরেছেন। এই অবস্থা থেকে চন্দননগরের আলোকশিল্পকে ঘুরে দাঁড় করাতেই এ বার বিশেষ আয়োজন।
চন্দননগরের কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটির সিদ্ধান্ত, আলোকশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে পথের ধারের আলোয় জোর দেওয়া হবে। কমিটির সাধারণ সম্পাদক শুভজিৎ সাউ বলেন, ‘‘সেরা পথ-আলোকসজ্জার নিরিখে ৫টি পুরস্কার দেওয়া হবে। এই পুরস্কার এ বারেই প্রথম।’’
এমনিতেই পুজোর দিনগুলিতে শহরজুড়ে প্রচুর বাহারি আলোর তোরণ হয়। এ ছাড়া, পুজো মণ্ডপগুলি জুড়েও আলোর বন্যা থাকে। বিসর্জনের শোভাযাত্রায় নিজেদের কারিকুরি দেখানোর জন্য মুখিয়ে থাকেন আলোকশিল্পীরা। গত বছর করোনা আবহে শোভাযাত্রা হয়নি। এ বারেও হবে কি না, নিশ্চিত নয়। দুর্গাপুজো, কালীপুজোতেও সে ভাবে বরাত মেলেনি। তাই বহু আলোকশিল্পীর মুখ অন্ধকার। এই অবস্থায় এ বার পথের ধারে বাড়তি আলোর ব্যবস্থা করে তাঁদের মুখে হাসি ফেরানোর চেষ্টা হলেও শিল্পীদের একাংশের বক্তব্য, এই সিদ্ধান্ত কিঞ্চিত অক্সিজেন জোগালেও খারাপ পরিস্থিতি পুরোপুরি ঘুচবে না।
শহরের তালডাঙা, পালপাড়া, শাওলি বটতলা, বিদ্যালঙ্কা, কলুপুকুর, পঞ্চাননতলা জুড়ে আলোর কারখানা রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে শাওলি বটতলায় তপন ঘোষের কারখানায় দেখা গেল, দুই কর্মী পথের ধারের আলো তৈরির কাজ করছেন। শোভাযাত্রার জন্য দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেন, চা-বাগানের মহিলা শ্রমিক, রাজস্থানের মহিলা প্রভৃতি মডেল তৈরি করেছেন তপন। তাঁর কথায়, ‘‘একে মন্দা। এগুলো করে আরও সমস্যায় পড়লাম। শোভাযাত্রার ঠিক নেই। শোভাযাত্রা না হলে মডেলগুলি তৈরির টাকা আটকে থাকবে।’’ দুর্গাপুজোয় এ বার তিন জায়গায় বরাত পেলেও অন্যান্য বারের বাজেটের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তপনের কারখানায় করোনা-পর্বের আগে জনাকুড়ি কারিগর ছিলেন। এখন অর্ধেক। তিনি বলেন, ‘‘এখন স্ট্রিট লাইট ভাল করতে হবে। সেটাই লক্ষ্য। শোভাযাত্রার আলোর বাহার পথ-আলোয় আসবে না। তবু, নিরাশায় এটাই কিছুটা হলেও আশার আলো।’’
বিদ্যালঙ্কার মনোজ সাহা জগদ্ধাত্রী পুজোয় কাজ ধরেননি। তার আলো যাচ্ছে অযোধ্যায়, ধনতেরসে। তিনি জানান, ব্যবসার বহর অনেক কমেছে। ২০১৯ সালে পুরুলিয়ায় একটি দুর্গাপুজোয় ৭ লক্ষ টাকার বরাত পেয়েছিলেন। গত বছর তা ৩ লক্ষ হয়। এ বার তা ২ লক্ষ টাকায় নেমেছে। করোনা পরিস্থিতিতে মুদিখানা দোকান খুলেছেন তিনি।
কলুপুকুর বাউরিপাড়ার পিন্টু মুখোপাধ্যায়ের কারখানাতেও কাজের গতি মন্থর। করোনার আগে তাঁর কাছে ২৪-২৫ জন কাজ করতেন। পুজোর মরসুমে আরও জনাদশেক। এখন কর্মী ৬ জন। কলকাতার বড় মণ্ডপে, ভিন্ রাজ্যে তাঁর আলো গিয়েছে। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এ বার দুর্গাপুজোয় দু’জায়গায় আলো লাগিয়েছেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এক-দেড় ভাগ টাকার বিনিময়ে।
তবু, আশার আলো দেখছেন পিন্টু। রাস্তার ধারের আলো লাগাবেন বাউরিপাড়া শীতলাতলা এবং তালপুকুরধার শিশু উদ্যানে। তাতেই নিজের জাত চেনাতে হবে। আলোয় কী চমক দেওয়া যায়, ভেবে চলেছেন। ঠিক করেছেন, আলো-শব্দের ‘এফেক্ট’ দেবেন। থাকবে করোনা থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর আর্তি। তিনি বলেন, ‘‘ধরেই নিয়েছি, শোভাযাত্রা বোধহয় হবে না। তবে, স্ট্রিট লাইট লাগানোর সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে অক্সিজেনের মতো। শুনছি, প্রাইজও থাকবে।’’ একই ভাবনার শরিক উর্দিবাজারের আলোকশিল্পী সহোদর মহম্মদ মুস্তাফা, মহম্মদ রুস্তম এবং তাঁদের মতো অনেকেই।