ধূলিসাৎ: কিছুদিন আগেও বিদ্যামন্দিরের সামনে ছিল গান্ধীজির মূর্তি, শহিদ বেদীও । ছবি: তাপস ঘোষ
স্বদেশি আন্দোলনের স্মৃতিধন্য চুঁচুড়ার বিদ্যামন্দির ভবন গুঁড়িয়ে স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছরে শুরু হল আবাসন নির্মাণ। এ নিয়ে শহরের অনেকেই ক্ষুব্ধ। কার স্বার্থে ওই ভবন ভেঙে বহুতল হচ্ছে, জবাব চেয়ে পোস্টার পড়েছে পুরপ্রধানের নামে। শহরবাসীর একাংশের দাবি, জায়গাটি দেবত্র সম্পত্তি। ইচ্ছেমতো নির্মাণ বেআইনি।
ইতিহাস চর্চাকারী, চুঁচুড়ার বাসিন্দা সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘‘বিপ্লবীদের পীঠস্থান মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল। খারাপ লাগছে।’’ পুরপ্রধান অমিত রায় বলছেন, ‘‘বিদ্যামন্দির ভবন বাঁচানোর চেষ্টা করা হলেও জমি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন থাকায় কিছু করা যায়নি। যে প্রোমোটার আবাসন করছেন, তাঁকে একটি ঘর দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। ঘর পেলে সংগ্রহশালাকরা হবে।’’
এক শতক আগে দেশে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভূপতি মজুমদার, অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, হামিদুল হক, সিরাজুল হকের মতো বিপ্লবীদের চেষ্টায় ইমামবাড়ার কাছে বিদ্যামন্দির ভবন গড়ে ওঠে। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী রবি পাল। শিক্ষালাভ, শরীরচর্চার পাশাপাশি স্বদেশি আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হত ওখানে। শিক্ষক এবং ছাত্র হিসাবে বহু বিপ্লবী আসতেন। শিক্ষক জ্যোতিষচন্দ্রকে একাধিক বার গ্রেফতার করে চার্লস টেগার্ট অত্যাচার করেছেন। ছাত্র গোপীনাথ সাহা টেগার্টকে হত্যা করতে গিয়ে ভুল করে অন্য এক সাহেবকে মেরে ধরা পড়েন। ফাঁসি হয় গোপীনাথের। যে আত্মবলিদানের শতবর্ষ চলছে।
ধূমকেতু পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা প্রকাশের ‘অপরাধে’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এক বছর কারাদণ্ড হয়। বিদ্যামন্দির ভবনের অদূরে বর্তমান হুগলি জেলে বন্দি থাকাকালীন অনশন করেন বিদ্রোহী কবি। চিঠি মারফত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে অনশন ভাঙেন। জেল থেকে বেরিয়ে নজরুল আশ্রয় নেন বিদ্যামন্দির ভবনে। বিদ্যামন্দিরে গান শিখিয়েছেন নজরুল। বিদ্যামন্দিরের ছাত্রেরা নজরুলের সঙ্গে তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশেরা। আগামী মে মাসে সেই আন্দোলনের শতবর্ষ শুরু হবে।
এ হেন ভবন পুরোপুরি ভেঙে জায়গাটি টিন দিয়ে ঘেরা হয়েছে। কিছু দিন ধরে শুরু হয়েছে নির্মাণের কাজ। প্রাক্তন পুরপ্রধান আশিস সেনের দাবি, ‘‘আমি পুরপ্রধান থাকাকালীন বিদ্যামন্দির ভবন বাঁচাতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। ভবনের সামনে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি বসানো হয়েছিল। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সব শেষ হয়ে গেল।’’
চুঁচুড়ারই বাসিন্দা, আইনজীবী জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘জমিটি দেবত্র সম্পত্তি। বেআইনি ভাবে জমির চরিত্র বদল করে আবাসন হচ্ছে।’’ পুরপ্রধানের বক্তব্য, ‘‘জায়গাটি দেবত্র সম্পত্তিই ছিল। ওখানে আবাসনের অনুমতি দেওয়া হয় ২০২১ সালে। তখন আমি পুরপ্রধান নই।’’ তৎকালীন পুরপ্রধান গৌরীকান্ত মুখোপাধ্যায়ের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘উনি (অমিত) তখন উপ-পুরপ্রধান। বেআইনি হলে আপত্তি করেননি কেন? এখনই বা প্ল্যান বাতিল বা কাজ বন্ধ করছেন না কেন?’’ অমিত বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট কাগজপত্র আনলে আমাকেও অনুমতি দিতে হত।’’
ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তি বলে পুরসভা দায় ঝাড়তে পারে কি না, উঠছে সেই প্রশ্ন। অনেকেই বলছেন, কোন্নগর শহরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ি প্রোমোটারের হাতে চলে গিয়েছিল। কয়েক বছর আগে পুরসভা উদ্যোগী হয়ে তা আটকে দেয়। বাড়িটি পুরসভার তরফেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বিদ্যামন্দিরের ক্ষেত্রে হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভার এই সদিচ্ছা দেখা যায়নি।
পুরসভার খবর, ওই দেবত্র সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব স্থানীয় নন্দী পরিবারের হাতে ছিল। সে কথা স্বীকার করেছেন ওই পরিবারেরসদস্য অরুণকুমার নন্দী। সেখানে আবাসন তৈরি হচ্ছে কী ভাবে, এর উত্তর তিনি দেননি।