বিক্রির জন্য গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে সবুজসাথীর সাইকেল। গোঘাটের কামারপুকুরে। ছবি: সঞ্জীব ঘোষ।
পীযূষ নন্দী
আরামবাগ
যাদের জন্য সরকারি প্রকল্প, তারা পড়ছে বিপাকে। সুবিধা হচ্ছে অন্যের!
প্যাডেলে চাপ দিতেই কারও সাইকেলের চেন কাটছে, কারও চাকা টলমল করছে। আচমকা টায়ার ফেটে বিপত্তিও কম নয়। ‘সবুজসাথী’-র সাইকেল নিয়ে পথে বেরিয়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে আরামবাগ মহকুমার ছাত্রছাত্রীদের। সাইকেল সারানোর দোকানগুলিতে অবশ্য ‘পৌষ মাস’। প্রকল্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ দোকানিরা। অঢেল কাজ আসছে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কামারপুকুর চটি থেকে লাহাবাজার— এই দু’কিলোমিটারের মধ্যে খানদশেক সাইকেল সারানোর দোকান ছিল। এখন ৫০টিরও বেশি।
নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য ২০১৫ সালে এই প্রকল্পটি চালু করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাইকেলগুলির মান নিয়ে আগেও নানা জায়গা থেকে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু আরামবাগে যে হারে সাইকেল সারানোর দোকান গজাচ্ছে, তাতে ফের একবার ওই প্রশ্ন সামনে আসছে।
বিধানসভা নির্বাচনের মুখে মঙ্গলবার ওই সাইকেলের বরাত দেওয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। প্রশ্ন তোলেন সাইকেলের মান নিয়েও। তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা দাবি করেন, ‘‘শুভেন্দু প্রমাণহীন কথা বলে চলেছেন।’’
রাজনীতির চাপান-উতোর যা-ই থাক, সাইকেলের মান নিয়ে আরামবাগের ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকেরা অসন্তুষ্ট। অনেকে ইতিমধ্যে বিক্রিও করে দিয়েছে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আরামবাগের বড়ডোঙ্গল হাইস্কুলের ছাত্র তারাকান্ত দাস ওই সাইকেল পেয়েছিল। এখন সে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। কতবার যে তাকে সাইকেল সারাতে হয়েছে!
তারকান্তর কথায়, ‘‘প্রথমবার প্যাডেলে চাপ দিতেই চেন কেটে গিয়েছিল। চাকাও টলমল করছিল। কাকা সাইকেলের দোকানে নিয়ে যান। সারাতে ৫০০ টাকা লেগেছিল। মাসখানেক যেতে না যেতে টায়ার ফেটে গেল। টিউবও পাল্টাতে হল। দিন ১৫-২০ অন্তর কিছু না কিছু সারাই করতে হচ্ছেই।’’ আরামবাগ গার্লস স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী মৌলি ঘোষ বলে, ‘‘যে দিন সাইকেল পাই, সে দিনই সারাতে ৪০০-৫০০ টাকা লেগেছিল। রোজই সাইকেলের কিছু না কিছু খারাপ হচ্ছে।’’
আরামবাগ গার্লস স্কুলেরই এক ছাত্রীর মা সমিতা সরকার ১৮০০ টাকায় ওই সাইকেল বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘সাইকেলগুলোতে কিচ্ছু নেই। একে তো ফিটিংসে হল। দিনকয়েকের মধ্যে টায়ার-টিউব পাল্টাতে হল। বেল বাজছিল না। লক খারাপ হল। ব্রেক, সাইকেলের রিং— সব এত নিম্নমানের যে সেটা নিয়ে বাইরে বের হওয়াই ঝুঁকির ছিল।’’
তবে, ওই সাইকেলের কদর উত্তরোত্তর বাড়ছে সারানোর দোকানগুলিতে। কামারপুকুরের লাহাবাজারের তেমনই এক দোকানি সৌমেন কর বলেন, ‘‘আগে সারা দিনে সাইকেল সারানোর খদ্দের মিলত না। দিনমজুরিও করতে হত। প্রকল্পটা চালু হওয়ার পর থেকে দুপুরে খাওয়ার সময় পাচ্ছি না। মাসে অন্তত ১৫০-২০০টি ওই সাইকেল সারাচ্ছি।’’
শেখ নওসের আলি নামে হাসপাতাল রোডের আর এক দোকানি বলেন, ‘‘ওই সাইকেলের যন্ত্রাংশ নিম্নমানের। তা ছাড়া, মাল ফিটিংসেও গোলমাল থাকে। যেমন, চাকার টাল ভাঙা থাকে না। স্পোক আলগা থাকে। অনেক স্ক্রু লাগানোর জায়গা ফাঁকা থাকে। ১২০০-২০০০ টাকার মধ্যে প্রচুর সাইকেল বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।” সাইকেলের মান নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনিক স্তর থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে, হুগলিতে ওই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) নকুলচন্দ্র মাহাতো বলেন, ‘‘অভিযোগ যাতে না আসে, তা নিয়ে আমরা পদক্ষেপ করেছি। যে সংস্থা থেকে সাইকেল আসছে, তাদের জানানো হচ্ছে। এ ছাড়াও সমস্ত ব্লকে যেখানে যেখানে ফিটিংস হচ্ছে, সেখানেও নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যাতেঅভিযোগ না আসে।’’