ফাইল চিত্র।
আমার জন্ম, পড়াশোনা, বিয়ে, রাজনীতি— সবই হাওড়ায়। হুগলি জেলা সিপিএমের তৎকালীন সম্পাদক বিজয় মোদক ছিলেন আমার জেঠামশাই। তিনিই আমার রাজনৈতিক গুরু। আমার বড় হওয়াটা তাই বামপন্থী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে।
১৯৯৪ সালে পুর নির্বাচনে প্রথম দাঁড়িয়ে জয়লাভ করার পরে বরো চেয়ারম্যান হই। পরে দু’বার মেয়র পরিষদের সদস্য হয়েছিলাম। ২০০৮ সালে হাওড়ার মেয়র নির্বাচিত হই। ২০১৫ সালে অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে সিপিএম ছেড়ে দিই। তার পর থেকে দলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।
মেয়র হওয়ার পরে বুঝেছি, হাওড়ার মানুষের পুর পরিষেবা হিসাবে মূল চাহিদা পরিস্রুত পানীয় জল এবং উপযুক্ত নিকাশি ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে তাঁরা চান ভাল রাস্তাঘাট, পর্যাপ্ত আলো, আবর্জনা-মুক্ত হাওড়াকে। আমি মেয়র হয়ে সে সবেই গুরুত্ব দিয়েছিলাম। আসলে দীর্ঘদিনের পুরনো হাওড়া শহর গড়ে উঠেছে পরিকল্পনাহীন ভাবে। ফলে সমস্যায় জর্জরিত প্রাচীন শহরটি। ভেবেছিলাম অনেক কিছু। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সব কাজ শেষ করে উঠতে পারিনি। যার অন্যতম কারণ দীর্ঘসূত্রতা। যে কোনও কাজের অনুমোদন পেতে বছরের পর বছর গড়িয়ে যেত।
তৃণমূলের আমলে দেখছি, যেখানে প্রয়োজন, মুখ্যমন্ত্রী আগে সেখানেই কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। দিদির এই ‘ডু ইট নাউ’-এর জন্যই তাঁর এত জনপ্রিয়তা। যা বলেছেন, করে দেখিয়েছেন। সরকার এমনই হওয়া চাই। যা ভাবব, সেটা করতে দিতে হবে। কিন্তু আমার সময়ে কাজ করতে গেলেই পিছন থেকে টেনে ধরা হয়েছে। দ্রুত নিকাশি ব্যবস্থার জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকল্প রূপায়িত করতে পারিনি। আমার মতে, রাজনৈতিক দলগুলি সঙ্কীর্ণ গণ্ডি থেকে বেরোলে তবেই হবে উন্নয়ন। মানুষের ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ পাল্টাচ্ছে। সে সবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
গত ১০ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কাজ করেছেন, তাতে তিনি মহিলাদের মনে দীর্ঘস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিই মানুষকে তাঁর দিকে টেনেছে। অন্যান্য রাজের মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে যা শিক্ষণীয়। কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো কত প্রকল্প করেছেন মুখ্যমন্ত্রী! অথচ নোটবন্দি করে অচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে বিজেপি মানুষকে কিছুই দিতে পারেনি। মৌলবাদ আর উগ্র হিন্দুত্ববাদ দেশটাকে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের উপর বাড়ছে খরচের বোঝা। জ্বালানির দাম আর বাজারের অগ্নিমূল্য রোখা না-গেলে নিস্তারের পথ নেই। সে কাজে দেশের মূল স্তম্ভ হিসাবে তৃণমূলকে এগিয়ে দিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ছেন, তার ফল ২০২৪-এর নির্বাচনে বোঝা যাবে।
আমাদের সময়ে আর্থিক সীমাববদ্ধতা ছিল। সেই অনুযায়ী কাজ হত। পুরসভায় দুর্নীতি রুখতে এক জন অফিসারকে সাসপেন্ড করেছিলাম। এটা যে কোনও পুরসভায় চলতেই থাকে। এখন কী হয় জানি না। তবে এখন যে ভাবে উন্নতি হয়েছে, তা বলার মতো অবশ্যই। রাস্তাঘাট, রাস্তার আলো— এ সবে পুর পরিষেবা ঠিকঠাক। কয়েক দিন আগে সাঁতরাগাছিতে গিয়েছিলাম। ছোট সঙ্কীর্ণ গলিকেও দেখলাম পেভার ব্লক দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। হাওড়ায় অনেক পুকুর সুন্দর করে বাঁধানো হয়েছে, ঝিলের চারপাশে সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। এ সবই তো পরিবর্তন।
আমাদের সময়ে বর্ষা চলে গেলে আবহাওয়া দফতরের সঙ্গে কথা বলে নিকাশি নালা থেকে পলি তোলা হত। হাওড়া আসলে একটা বাটির মতো। জল জমলে বেরোতে চায় না। এ জন্য হাওড়ার উন্নয়নমূলক সংস্থাগুলিকে এক ছাতার নীচে আনা প্রয়োজন বলে মনে করি।
হাওড়ায় বেআইনি নির্মাণ একটা বড় সমস্যা। যখনই সেই নির্মাণ ভাঙতে যাব বলে নোটিস পাঠিয়েছি, তখনই আদালতের স্থগিতাদেশ চলে আসত। এই রহস্যজনক কারণে কাজ এগোতো না। আমি চাই, কলকাতার মতো হাওড়াতেও গগনচুম্বী বাড়ি হোক। কিন্তু, সেটা হোক নিয়ম মেনে। হাওড়া শহরের উপরে ক্রমশ চাপ বাড়ছে। তাই শহরকে পশ্চিম দিকে বাড়াতে হবে। রাস্তাঘাট-সহ উন্নয়ন শহরের বাইরেও ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমবে।
(লেখক প্রাক্তন মেয়র, হাওড়া)