উলুবেড়িয়ার নোনা অ্যাথলেটিক ক্লাবের মণ্ডপের কাজ চলছে জোরকদমে। ছবি: সুব্রত জানা
করোনা যায়নি। কলকাতা হাই কোর্ট এ বারও মণ্ডপ দর্শকশূন্য রাখার নির্দেশ দিয়েছে। তা সত্ত্বেও উলুবেড়িয়ায় পুজো আয়োজনের ছবিটা এ বার পাল্টাচ্ছে অনেকটাই। স্পনসর এসেছে। ফলে, গতবারের চেয়ে বাজেট প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে অনেক পুজো কমিটির। ফিরছে আড়ম্বর। যা অর্থনৈতিক মন্দা কাটার একটা লক্ষণ বলে দাবি করছেন অনেক পুজো উদ্যোক্তা।
গত বছর করোনা আবহে উলুবেড়িয়ার গ্রামীণ হাওড়ার বেশির ভাগ জায়গাতেই পুজো হয়েছিল আড়ম্বরহীন, সাদামাটা ভাবে। স্পনসরও সে ভাবে মেলেনি বলে দাবি পুজো উদ্যোক্তাদের। আর এ বার?
উলুবেড়িয়ার নোনা অ্যাথলেটিক ক্লাবের গতবারের বাজেট ছিল প্রায় তিন লক্ষ টাকা। এ বারে প্রায় ৬ লক্ষ। থিম— ‘রাঙা মাটির দেশে’। বাউড়িয়ার রামেশ্বরপুর যুবগোষ্ঠীর গতবারের পুজো-বাজেট ছিল তিন লক্ষ টাকা। এ বারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লক্ষ টাকায়। মন্দিরের আদলে হচ্ছে মণ্ডপ। উলুবেড়িয়ারই গরুহাটা ময়দানের কাছে নোনা ফিজিক্যাল সর্বজনীনের গতবারে বাজেট ছিল ৩ লক্ষ টাকা। এ বারে প্রায় দ্বিগুণ। জেলা জুড়ে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে।
করোনার জেরে এই দু’বছরে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। জিনিসপত্র ও জ্বালানির দাম বেড়েই চলেছে। অর্থসঙ্কটে খাবি খাচ্ছেন অধিকাংশ সাধারণ মানুষ। পুজোর বাজার এখনও জমেনি। জামাকাপড়ের দোকানি খদ্দেরের জন্য তাকিয়ে রয়েছেন রাস্তার দিকে। এই আবহে এত টাকার সংস্থান কী করে করছে পুজো কমিটিগুলি?
উদ্যোক্তাদের দাবি, তাঁর নির্ভর করছেন স্পনসরদের উপরেই। নোনা অ্যাথলেটিকের সম্পাদিকা চুমকি ঘোষ বলেন, ‘‘সদস্যদের চাঁদা এবং স্পনসরের টাকায় পুজো হয়ে যাবে। দূর থেকেই মণ্ডপ দেখবেন দর্শক।’’ নোনা ফিজিক্যালের অন্যতম কর্তা সুজিত মণ্ডল বলেন, ‘‘সদস্যদের চাঁদা এবং স্পনসরদের কাছ থেকে টাকা উঠে যাবে।’’ রামেশ্বরপুর যুবগোষ্ঠীর কর্তা সুরজিৎ দাস বলেন, ‘‘সদস্যদের চাঁদা তো বটেই, আমাদের এলাকা শিল্পপ্রধান। ফলে, কারখানাগুলি থেকে চাঁদা ওঠে। মেলা বসাই। সেখান থেকেও আয় হয়।’’
মন্দার বাজারে স্পনসরই বা কারা?
কিছু শিল্প ধীরে ধীরে মন্দা কাটিয়ে ভাল ব্যবসা করছে বলে দাবি করেছেন উলুবেড়িয়ার আবাসন ব্যবসায়ী গৌতম বসু। তিনি একদিকে নোনা অ্যাথলেটিকের সম্পাদক, আবার শহরের বহু পুজোর স্পনসর। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি কমিয়েছে। ব্যাঙ্কগুলিও গৃহঋণে সুদ কমিয়েছে। ফলে, কিছুটা হলেও খরা কেটেছে আবাসন ব্যবসায়। এই ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে রড, সিমেন্ট, আসবাবের ব্যবসা। আমাদের মতো আবাসন ব্যবসায়ীরা তো বটেই, রড এবং সিমেন্ট সংস্থাগুলিও সরাসরি পুজো স্পনসর করছে। বদ্ধ অর্থনীতি যে মুক্তি চাইছে, তা কিছুটা হলেও টের পাওয়া যাচ্ছে পুজোর বাজেট বৃদ্ধিতে। এই টাকার বেশিরভাগ অংশ আসছে শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্র থেকে।’’
উলুবেড়িয়ায় প্রচুর নার্সিংহোম আছে। পুজো কমিটিগুলি দেদার বিজ্ঞাপন পেয়েছে সেখান থেকেও। নার্সিংহোম মালিকদের একটি অংশ জানান, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের দৌলতে এবং করোনা আবহে তাঁদের ব্যবসা ভাল হয়েছে। তাই তাঁরা পুজোগুলিকে সহায়তা করতে পারছেন। তবে, ভিন্নমত পোষণ করে উলুবেড়িয়ারই একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক তথা চিকিৎসক সুশান্ত মাইতি বলেন, ‘‘ব্যবসা যদি ভালও হয়, তা হলেও নার্সিংহোমগুলি কেন পুজো উপলক্ষ্যে খরচ করবে? যে টাকা তারা পুজোতে চাঁদা দেয়, সেই টাকায় তারা রোগীর বিলে ছাড় দিতে পারত। সেটা অনেক বেশি জনকল্যাণকর হতো।’’ একই বক্তব্য অনেক সাধারণ মানুষেরও।
পুজো কমিটিগুলির অবশ্য পাল্টা দাবি, পুজোর বাজেট বৃদ্ধিও একদিক দিয়ে জনকল্যাণ। পুজোর সময়ে সরাসরি সমাজকল্যাণকর কাজ করা হয়। নোনা ফিজিক্যালের সুজিতবাবু বলেন, ‘‘মণ্ডপ তৈরির কাজে বহু শ্রমিক লাগে। পুজোর সময়ে তাঁরা কিছুটা হলেও পয়সার মুখ দেখবেন। গতবারে তো তাঁরা তেমন ভাবে কাজই পাননি।’’ নোনা অ্যাথলেটিকের চুমকি বলেন, ‘‘আমরা জানি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয়। আড়ম্বরের মধ্যে যাতে সেই সত্য ঢাকা না পড়ে, সেটার দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা পুজোর সময়ে গরিব ছেলেমেয়েদের হাতে পুজোর উপহার তুলে দেব। যে টাকা বাঁচবে, তাতে সারা বছর গরিব ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পিছনে খরচ করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ সুরজিৎ বলেন, ‘‘বস্ত্র বিতরণ ছাড়াও নানা ধরনের সমাজকল্যাণকর কর্মসূচির পরিকল্পনা আছে আমাদের।’’