আগুয়ান: বুল্টির দৌড় নিজস্ব চিত্র
টালির চালের একচিলতে ঘরে স্বামী, দুই সন্তানকে নিয়ে বাস। পুষ্টিকর খাবার জোটে না। তবু, হার মানতে নারাজ তারকেশ্বরের বুল্টি রায়। মাঠে নামলেই জেতার খিদে বেড়ে যায়। সম্প্রতি জাতীয় এবং রাজ্য প্রতিযোগিতায় চারটি ইভেন্টে নেমে চারটিতেই সোনা জিতেছেন এই অ্যাথলিট।
সোনার মেয়ে বলছেন, ‘‘শস্তার জুতো পরে দৌড়ই। এ বার লোকজনের থেকে চেয়েচিন্তে একটা ভাল জুতো কিনেছি। তাতে সময় আরও ভাল হচ্ছে, বুঝতে পারছি।’’
গত ২৭ এপ্রিল থেকে পয়লা মার্চ ৪২ তম জাতীয় মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ হল চেন্নাইতে। সেখানে ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার দৌড় এবং ৪০০ মিটার হার্ডলসে নেমেছিলেন ৩০ বছরের বুল্টি। তিনটিতেই চ্যাম্পিয়ন। গত শনিবার সল্টলেকে সাইয়ের মাঠে রাজ্য মিটে ৪০০ মিটার হার্ডলসেও (সিনিয়র) সেরা। সামনে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার হাতছানি। কিন্তু, সুযোগ পেলে সেখানে যাওয়ার প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথার দৌড় থেমে যায় তাঁর।
বুল্টির বাপের বাড়ি জাঙ্গিপাড়ায়। বাবা মনতোষ রায় খেতমজুর। এক বার গরু বেচে মেয়েকে খেলার গেঞ্চি-প্যান্ট-জুতো কিনে দিয়েছিলেন তিনি। বিয়ের পরেও অভাব ঘোচেনি বুল্টির। স্বামী সন্তোষ ট্রেনে শশা বিক্রি করেন। করোনা-পর্বে রোজগার কার্যত বন্ধ ছিল। মেয়ে বিন্দিয়া পঞ্চম, ছেলে শিবশঙ্কর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তারকেশ্বরের জয়কৃষ্ণ বাজারের বটতলার জীর্ণ ভাড়াবাড়িতে কষ্টেই চলে চার জনের সংসার।
তারকেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে সকাল-বিকেল অনুশীলন করেন বুল্টি। প্রতিযোগিতা থাকলে কিছু দিন আগে থেকে সপ্তাহে দু’-এক দিন করে সল্টলেকে সাইয়ের মাঠে ছোটেন সিন্থেটিক টার্ফে প্র্যাকটিসের জন্য। তারকেশ্বরের প্রবীণ কোচ শিবপ্রসাদ ধাড়া বুল্টির গুরু। বেশ কয়েক বছর শিবপ্রসাদবাবু অসুস্থ। তাই, কোচহীন অবস্থাতেই চলছে বুল্টির ছুট।
মঙ্গলবার দুপুরে বাড়িতেই ছিলেন এই অ্যাথলিট। রান্না করেছিলেন ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ আর ঢেঁড়শের ঝাল। সুষম আহারের কথা শুনে হেসে ফেলেন। বলেন, ‘‘ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ, ছেলেমেয়ের দেখভাল করে নিজেদের জন্য কী থাকে বলুন! দুধ বা এনার্জি ড্রিঙ্ক দূর, নিয়ম করে রোজ একটা গোটা ডিমও পাতে পড়ে না। পান্তাভাত, মুড়ি খেয়েই মাঠে ছুটি।’’
স্কুল ন্যাশনাল, রাজ্য এবং জাতীয় প্রতিযোগিতায় একাধিক বার নেমেছেন তিনি। সাফল্যও মিলেছে। বঙ্গকন্যার চোখে অলিম্পিকের স্বপ্ন। জানান, একটা চাকরি পেলে আরও বেশি করে ঝাঁপাতে পারবেন। তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অনুরোধ, একটা চাকরি দিন। তা হলে সংসারটা একটু ভাল ভাবে চালাতে পারব। খেলাও ধরে রাখতে পারব।’’
বুল্টি জানান, চেন্নাই যেতে কেউ ৫০০, কেউ হাজার, কেউ আরও কিছু বেশি টাকা দিয়েছেন। তারকেশ্বরেরই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদিকা শম্পা ঘোষ বলেন, ‘‘বুল্টি স্পনসর পাননি জেনে অপেক্ষাকৃত দামি জুতো কেনা থেকে ট্রেনের টিকিট বা হাতখরচের বিষয় যতটা সম্ভব, আমরা দেখেছি। বুল্টি নিরাশ করেননি। সোনা জিতে আমাদের গর্বিত করেছেন।’’ রবিবার ওই সংস্থার তরফে বুল্টিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ধনেখালির একটি সংস্থাও বুল্টির পাশে দাঁড়ায়।
শ্রীরামপুরের জগন্নাথ স্পোর্টিংয়ের হয়ে প্রতিযোগিতায় নামেন বুল্টি। তিনি জানান, ওই ক্লাবের সভাপতি তথা শ্রীরামপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান (বর্তমানে কাউন্সিলর) অমিয় মুখোপাধ্যায়ও সাহায্য করেন। তবে হাত পেতে সাহায্য নয়, সংসার সামলে নিজের প্রতিভাকে আরও বেশি করে মেলে ধরতে একটা চাকরি চান এই মহিলা অ্যাথলিট।