ন’বছর পরে শাস্তি পেলেন দোষীরা। প্রতীকী চিত্র।
ন’বছর আগে আমতার মুক্তিরচকের একই পরিবারের দুই মহিলাকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। সেই মামলায় আট জনকে বৃহস্পতিবার দোষী সাব্যস্ত করল আমতা আদালত। সাজা ঘোষণা হবে কাল, শনিবার।
বৃহস্পতিবার আমতা আদালতের বিচারক রোহন সিন্হা যে আট জনকে দোষী সাব্যস্ত করলেন, তারা হল— বরুণ মাখাল, বংশী গায়েন, নব গায়েন, সৈকত মণ্ডল, গৌতম মাখাল, সুকান্ত পাত্র, গৌরহরি মাখাল এবং শঙ্কর মাখাল। মোট অভিযুক্ত ছিল ১০ জন। তাদের মধ্যে জগৎ মণ্ডল এবং রঞ্জিৎ মণ্ডলকে আদালত নির্দোষ ঘোষণা করেছে। দোষীদের এ দিনই বিচার বিভাগীয় হেফাজতে নিয়ে নেওয়া হয়।
আট জনই তৃণমূল কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তবে, দলের উলুবেড়িয়া উত্তরের বিধায়ক নির্মল মাজি তাদের দলীয় কর্মী হিসেবে মানতে চাননি। আট জনের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার খবর শুনে খুশি দুই নিগৃহীতা। তাঁরা জানান, দোষীরা সর্বোচ্চ সাজা পেলে তাঁরা আরও বেশি আনন্দিত হবেন। একইসঙ্গে তাঁদের খেদ, দু’জন ছাড়া পাওয়ায়। তাঁদের পরিবারের লোকেরা এ দিন আদালতে এসেছিলেন।
মামলার সরকারি আইনজীবী সিদ্ধার্থ মজুমদার জানান, আট জনকে আদালত ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৯ (অবৈধ জমায়েত), ৩২৩ (অস্ত্র ছাড়া শারীরিক নিগ্রহ এবং মারধর), ৪৫০ (বেআইনি ভাবে প্রবেশ) এবং ৩৭৬ডি (গণধর্ষণ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে। গণধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড। সর্বনিম্ন সাজা ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। দু’টি সাজার ক্ষেত্রেই জরিমানাও আছে। সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে দু’জন বেকসুর খালাস পেয়েছেন। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সাজা ঘোষণা হবে বলে বিচারক জানিয়েছেন।
বিচারক দোষী সাব্যস্ত করার পরে এ দিন আট জনকেই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সাজা কী হতে পারে, তা জানিয়ে দেন। তাদের বক্তব্যও জানতে চান। দোষীরা কাঠগড়ায় উঠে দাবি করে, তারা নির্দোষ। রাজনৈতিক কারণে তাদের ওই ঘটনার সঙ্গে জড়ানো হয়েছে।
বিচারক আইনজীবীদের মতামত চান। সরকারি আইনজীবী ঘটনাটিকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ মন্তব্য করে সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন। দুই নিগৃহীতার আইনজীবী রেজাউল করিম জানান, এটি জঘন্যতম ঘটনা। তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। আসামি পক্ষের আইনজীবী মহম্মদ আরিফ বলেন, আইনে যা বিধান আছে, সেই অনুযায়ী সাজা হোক।
গণধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। পুলিশ জানিয়েছে, সে দিন রাত ১২টা নাগাদ দোষীরা মুক্তিরচকের ওই বাড়ির পাঁচিলের দরজা ভেঙে ঢোকে। সেই সময়ে সিপিএম সমর্থক ওই পরিবারের কোনও পুরুষ বাড়িতে ছিলেন না। এক মহিলা ও তাঁর জেঠশাশুড়িকে দোষীরা ধর্ষণ করে। দুই মহিলাকে শারীরিক নিগ্রহ এবং মারধরও করা হয়। এক মহিলার শিশুকন্যাকে দোষীরা আছাড় মেরে উঠোনে ফেলে দেয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তারা তাণ্ডব চালায়।
দুই মহিলা চিৎকার করলেও ভয়ে কোনও প্রতিবেশী আসেননি। গৃহবধূর শাশুড়ি কোনওমতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার টহলরত পুলিশকে খবর দেন। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই দোষীরা চম্পট দেয়। পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, গণধর্ষণের ঘটনা ঘটানোর আগে দোষীরা রাস্তা থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।
ঘটনার গুরুত্ব বুঝে পুলিশের পদস্থ কর্তারা ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গণ সংগঠনের প্রতিনিধিরাও আসেন। দুই মহিলাকে উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। অভিযোগের ভিত্তিতে দুদিনের মধ্যে পুলিশ দশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। মামলার তদন্তকারী অফিসার হন আমতার তৎকালীন সিআই শুভাশিস চক্রবর্তী। তিনি ঘটনার ৮৭ দিনের মাথায় ধৃতদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন। আদালতের নির্দেশে দুই নিগৃহীতার বাড়ির সামনে বসে পুলিশ প্রহরা।
কিন্তু সরকারি আইনজীবীনিয়োগে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে চার্জ গঠন হওয়ার পরেও শুনানি শুরু হতে দেরি হয়। শেষ পর্যন্ত সরকারি আইনজীবী নিয়োগের পরে ২০১৪-র নভেম্বর মাস থেকে শুনানি শুরু হয়। এর মধ্যে চার বার বিচারক বদলি হন। শুনানি চলাকালীন ধৃতেরা জামিন পেলেও হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা মুক্তিরচকে ঢুকতেপারত না।
মামলাটিতে ৪৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। যাঁদের মধ্যে ছিলেন পুলিশের বেশ কয়েক জন এবং আমতা ও উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালের অন্তত ১১ চিকিৎসক।
প্রথম থেকেই এই পরিবারের পাশে আছে সিপিএম। এ দিন আদালতেও এসেছিলেনসিপিএম নেতারা।