গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে রাজ্য সরকারের দেওয়া ‘দুর্গার ভান্ডার’ (অনুদান) প্রত্যাখ্যান করছে একের পর এক পুজো কমিটি। হুগলি জেলারই চারটি পুজো কমিটি জানিয়ে দিয়েছে, এ বার তারা ওই এককালীন ৮৫ হাজার টাকা অনুদান নিচ্ছে না। ক্রমশ প্রত্যাখ্যানের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে ‘দুর্গার ভান্ডার’ নিতে ইচ্ছুক কমিটিগুলোকে জমায়েতের জন্য জড়ো হতে বার্তা দিয়েছেন কোন্নগর পুরসভার চেয়ারম্যান স্বপন দাস।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় ‘চলচ্চিত্রম মোড়ে’ তাঁদের আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন চেয়ারম্যান স্বপন। তবে হোয়াট্সঅ্যাপে পুরপ্রধানের ওই বার্তা দেওয়া নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিজেপির দাবি, আরজি কর-কাণ্ডে নাগরিকদের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ প্রতিবাদকে দমিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ওই জমায়েত করা হচ্ছে। সরকারি অনুদানের সঙ্গে রাজনীতিকে গুলিয়ে দেওয়াই পুরপ্রধানের উদ্দেশ্য বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বিজেপি নেতা প্রণয় রায়।
রাজ্যের মহিলাদের জন্য সরকার ‘লক্ষ্ণীর ভান্ডার’ প্রকল্প চালু করেছিল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে। আর ‘দুর্গার ভান্ডার’ অর্থাৎ দুর্গাপুজোর অনুদান চালু হয়েছিল ২০১৭-১৮ সালে। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ পেতে হলে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, আধার কার্ডের প্রতিলিপি এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিবরণ দিয়ে সরকারের নির্দিষ্ট পোর্টালে আবেদন করতে হয়। ‘দুর্গার ভান্ডার’ পেতে গেলেও তেমনই পোর্টালে আবেদন করতে হয়। তার জন্য সংশ্লিষ্ট ক্লাবের হিসাবপত্র, তার আগের বছরের অনুদানের হিসাব, দমকলের ছাড়পত্র, বিদ্যুত সংযোগের নথিপত্র এবং আগের বছরের প্রদেয় বিদ্যুতের বিলও আপলোড করতে হয়। পার্থক্য একটিই— লক্ষ্মীর ভান্ডার পান মহিলারা এবং এটি মাসিক ভাতা। ‘দুর্গার ভান্ডার’ মেলে বছরে এক বার। সেটি পান ইচ্ছুক পুজো কমিটি।
প্রথমে ‘দুর্গার ভান্ডার’-এর অর্থের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার টাকা। পরে বাজারদরের কথা মাথায় রেখে অঙ্ক বাড়াতে থাকে সরকার। চলতি বছরে পুজো কমিটিগুলিকে ৮৫ হাজার টাকা করে সরকারি আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
কিন্তু আরজি কর-কান্ডের পর ‘দুর্গার ভান্ডার’ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে আসছে। উত্তরপাড়ার তিনটি এবং কোন্নগরের একটি দুর্গাপুজো কমিটি জানিয়েছে, এ বার তারা ওই অর্থ নিচ্ছে না। সেই মর্মে জেলা প্রশাসনের কাছে চিঠিও দিয়েছে তারা। আরও কয়েকটি ক্লাব মৌখিক ভাবে অনুদান প্রত্যাখ্যানের কথা বলেছে। তারই পাল্টা হিসাবে অনুদান নিতে ‘ইচ্ছুকদের’ জমায়েতে অংশ নেওয়ার ডাক দিয়েছেন কোন্নগরের পুরপ্রধান। তিনি জানিয়েছেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজেদের ব্যানার, পোস্টার নিয়ে জড়ো হতে হবে ওই পুজো কমিটির সদস্যদের। যে প্রসঙ্গে বিজেপির অভিযোগ, পুরপ্রধানের আহ্বানেই স্পষ্ট যে, অনুদান নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। বিজেপি নেতা প্রণয় সোমবার বলেন, ‘‘উত্তরপাড়া যে পথ দেখিয়েছে, তাতে কোন্নগরের মাস্টারপাড়া পা বাড়িয়েছে। রাজ্যে বিভিন্ন পুজো কমিটি আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ আর জাস্টিসের (বিচার) জন্য যাঁরা অনুদান ফিরিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের পাল্টা মিছিল করছে তৃণমূল!’’
পুরপ্রধানের বার্তা পাওয়ার পর পুজো কমিটিগুলির মধ্যে ‘মিশ্র’ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। কোন্নগর মাস্টারপাড়া পুজো কমিটির হিসাবরক্ষক স্বপন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘চেয়ারম্যান (পুরসভার) হোয়াট্সঅ্যাপে যে মেসেজ করেছেন, সেটা আমাদের কাছেও এসেছে। এর অর্থ হল, যাঁরা অনুদান বয়কট করছেন, তাঁদের চাপে রাখা। ওঁরা হয়তো চাইছেন, অনুদান নিতে ইচ্ছুকদের ডেকে বলে দেওয়া হবে পরে প্রত্যাখ্যানের কথা ঘোষণা করা যাবে না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘আমরা অরাজনৈতিক ভাবে অনুদান প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মহিলাদের কথা ভেবেই এই পদক্ষেপ। সেটাকে রাজনৈতিক রং দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা কখনও বলিনি যে, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। এ-ও বলিনি যে, শুভেন্দু অধিকারীর পদত্যাগ চাই।’’ কোন্নগর দেবপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সম্পাদক সায়ন্তন মিত্র বলেন, ‘‘পুরসভার চেয়ারম্যানের বার্তা আমরাও পেয়েছি। আমাদের পুজোর আয়োজন খুবই ছোট। সরকারি অনুদান তাই আমাদের কাছে জরুরি। কিন্তু কী কারণে জমায়েত বা কেন যেতে হবে, সেই বিষয়টা পরিষ্কার নয়। ওই মিছিল বা জমায়েত থেকে কি আরজি করের ঘটনার বিচারের দাবি উঠবে? সেটাও জানি না।’’ তাঁরা জমায়েতে যোগ দেবেন কি না, তা এখনও ঠিক করেননি বলে জানান সায়ন্তন।
কোন্নগরের পুরপ্রধানের দাবি, ‘গুজব’ রুখতেই এই পদক্ষেপ করেছেন। স্বপনের কথায়, ‘‘একটা মিথ্যা প্রচার সর্বত্র চলছে যে, কোন্নগরের সমস্ত পুজো কমিটিই নাকি অনুদান প্রত্যাখ্যান করছে। তার বিরুদ্ধে আমাদের জমায়েত। যাঁরা আসবেন, তাঁরা অনুদান পাবেন। যাঁরা আসবেন না, তাঁরাও পাবেন। কিন্তু কারা বয়কট করছেন না, সেটাই আমরা দেখে নিতে চাইছি।’’ বিজেপির অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্বপনের ব্যাখ্যা, ‘‘আমি চেয়ারম্যান বা দলের লোক হিসাবে জমায়েতের আহ্বান করিনি। দুর্গোৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। তা নিয়ে সমস্ত মিথ্যা প্রচার ঠেকাতেই উদ্যোগ নিয়েছি।’’ পাশাপাশি, ‘দুর্গারভান্ডার’ নিতে অস্বীকৃত ক্লাব বা কমিটিগুলিকে কটাক্ষ করে পুরপ্রধান বলেন, ‘‘ওরা এমন ভাব দেখাচ্ছে, যেন কত সামাজিক কাজ করে! ক্লাবের ১০০ শতাংশ লোক সিপিএম। তারা সমাজকে বার্তা দিলে আমরা তা মেনে নেব কেন? আমরা তো কোনও ঝান্ডা ছাড়াই সকলকে আসতে বলেছি।’’