বানতলার লেদার কমপ্লেক্সে এই ম্যানহোলেই পড়ে মৃত্যু হয়েছে তিন সাফাইকর্মীর। —নিজস্ব চিত্র।
জেনেশুনেও কাউকে বিষাক্ত গ্যাসের গহ্বরে পাঠিয়ে দেওয়াটাকে ‘বলি দেওয়া’ ছাড়া আর কীই বা বলা যায়!
আইন আছে। সুপ্রিম কোর্টের ভূরি ভূরি নির্দেশিকা রয়েছে। রয়েছে ক্ষতিপূরণের আদেশ। কিন্তু দেশে ম্যানহোল সাফাইয়ের ব্যবস্থাপনা এখনও সেই তিমিরেই। কলকাতার উপকণ্ঠে বানতলার চর্মনগরীর ঘটনা আরও এক বার সেটাই প্রমাণ করে দিল। ম্যানহোলে নেমে বর্জ্যমিশ্রিত পাঁকে ডুবে গেলেন তিন-তিন জন শ্রমিক। বিষাক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু হল তাঁদের। মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় কাজের সূত্রে এসেছিলেন ফরজ়েম শেখ, হাসি শেখ এবং সুমন সর্দার। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, লেদার কমপ্লেক্সের ভিতরে সেক্টর ৬ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অধীনে সাফাইয়ের কাজ করছিলেন তাঁরা। ম্যানহোল পরিষ্কার করতে প্রথমে নেমেছিলেন ফরজ়েম। তিনি বেশ কিছু ক্ষণ পরেও উঠে না-এলে তাঁকে তুলতে ম্যানহোলে নামেন বাকি দু’জন। পরে লেদার কমপ্লেক্স থানায় খবর দেওয়া হয়। দমকল এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এলাকায় উদ্ধারকাজ শুরু করে। প্রায় চার ঘণ্টা পরে তিন জনের দেহ উদ্ধার করা হয় পাঁকের মধ্যে থেকে।
লেদার কমপ্লেক্সের ম্যানহোলে তিন সাফাইকর্মী পড়ে গিয়েছেন। —নিজস্ব চিত্র।
ম্যানহোলে মানুষ নামানো বা ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ ১৯৯৩ সাল থেকে নিষিদ্ধ। ১১ বছর আগে ২০১৩ সালে এই সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়, ম্যানহোল সাফাই, মলমূত্র সাফাই বা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ কোনও মানুষকে দিয়ে করানো যাবে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে তেমন প্রয়োজন হলে ম্যানহোলে যাঁকে নামানো হচ্ছে, তাঁকে জীবন ও স্বাস্থ্যের সব রকম সুরক্ষা দেবে সরকার। এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই ম্যানহোল পরিষ্কারের কাজ চলছে। শুধু কলকাতা নয়, দেশের নানা প্রান্ত থেকে বার বার এই ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে হায়দরাবাদে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের প্রস্তুতি চলাকালীন ম্যানহোল পরিষ্কার করতে নেমে বিষাক্ত গ্যাসে মোট চার জন শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সংসদে এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে জানান, ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সেপটিক ট্যাঙ্ক বা ম্যানহোল সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে ৪০০-র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক শ্রমিকের দেহ। রবিবার বানতলায়। —নিজস্ব চিত্র।
পেটের দায়েই ম্যানহোলে পাঁক ঘাঁটতে নামেন মানুষ। আইন জেনে অথবা না-জেনে এই পেশা তাঁরা বেছে নিতে বাধ্য হন। সমাজের এই নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের হাতে টাকা নেই বলেই কি তাঁদের জীবনেরও দাম নেই? ম্যানহোলে বার বার ‘নরবলি’ সেই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে অবধারিত ভাবে। নিকাশি ব্যবস্থায় যন্ত্রপাতির প্রয়োগ চালু হলেও কর্মীদের পাঁকে নামিয়ে কাজ করানো হচ্ছে ন্যূনতম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই। তার ফলেই এত মৃত্যু। ঘটনাচক্রে, চার দিন আগেই ম্যানহোলে মানুষ নামানো নিয়ে কলকাতাকে সতর্ক করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। কোনও ভাবেই এই ধরনের কাজে মানুষকে ব্যবহার করা যাবে না, জানিয়ে দেয় শীর্ষ আদালত। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এবং হায়দরাবাদের প্রধান নির্বাহী কর্তাদের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত হলফনামা চাওয়া হয়েছে। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আদালতে হলফনামা দিয়ে ছয় শহরের প্রশাসনকে জানাতে হবে, ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ বন্ধ করার জন্য তারা কী কী পদক্ষেপ করেছে। হলফনামা জমা পড়ার আগেই আরও তিন জন ম্যানহোলের বলি হলেন বানতলায়। রবিবারের ঘটনার পর সেখানে গিয়েছিলেন কলকাতার মেয়র তথা পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তিনি জানান, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বানতলায় যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কী ভাবে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হল, কেন তাঁরা ম্যানহোলে নেমেছিলেন, তা তদন্ত করে দেখা হবে, দাবি ফিরহাদের।
বানতলায় ম্যানহোল থেকে শ্রমিক উদ্ধারের কাজ চলছে। —নিজস্ব চিত্র।
কী ঘটেছিল
রবিবার সকাল ৯টা নাগাদ বানতলার লেদার কমপ্লেক্সে সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে ম্যানহোলে পড়ে যান তিন শ্রমিক। প্রথমে এক জন ম্যানহোলে নেমেছিলেন। দীর্ঘ ক্ষণ পরেও তিনি উঠে না-আসায় বাকি দু’জন সেখানে নামেন। ওই নালার গভীরতা ছিল ১০ ফুট। বর্জ্যমিশ্রিত তরলে ডুবে গিয়েছিলেন তাঁরা। দুর্গন্ধে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। লেদার কমপ্লেক্স থানার পুলিশ, দমকল এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যেরা প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় তিন জনের দেহ উদ্ধার করেন। দেহগুলি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। ওই তিন জন কলকাতা পুরসভার (কেএমডিএ) অস্থায়ী কর্মচারী বলে জানা গিয়েছে। লেদার কমপ্লেক্সের ভিতরে সেক্টর ৬ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অধীনে সাফাইয়ের কাজ করছিলেন তাঁরা।
ঘটনাস্থলে মেয়র ফিরহাদ
সুপ্রিম কোর্টের হলফনামা তলবের চার দিনের মাথায় এই ধরনের ঘটনা, তিন মৃত্যু নিঃসন্দেহে অস্বস্তিতে ফেলেছে প্রশাসনকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে দুপুরেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, ‘‘ঠিকাদার হোক কিংবা আধিকারিক, এই ঘটনার দায় যাঁরই হোক না কেন, তিনি শাস্তি পাবেন। কেএমডিএ নিজেদের মতো করে তদন্ত করবে। পুলিশও খোঁজখবর করছে। আসলে এখানকার পরিস্থিতি নরককুণ্ড হয়ে রয়েছে। কেন তিন শ্রমিককে ম্যানহোলে নামতে হল, আমরা তার কারণ খুঁজব। তদন্ত হবে। এর পরে আর এমন ঘটনা ঘটবে না।’’
আইন কী বলছে
ভারতে ম্যানহোল বা নিকাশি নালায় মানুষ নামিয়ে কাজের ব্যবস্থা ১৯৯৩ সাল থেকে বেআইনি। ২০১৩ সালে নতুন করে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আইনে বলা হয়, ম্যানহোল সাফাই, মলমূত্র সাফাই বা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ কোনও মানুষকে দিয়ে করানো যাবে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে ম্যানহোলে নামাতে হলেও সংশ্লিষ্ট সাফাইকর্মীর জীবন এবং স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। কিন্তু ১১ বছর আগে আইন প্রণয়নের পরেও সাফাইকর্মীদের মৃত্যু এড়ানো যায়নি। নর্দমা, নিকাশি নালা কিংবা ম্যানহোল সাফ করতে গিয়ে একের পর এক মৃত্যু ঘটেছে সারা দেশে। যার সাম্প্রতিক সংযোজন লেদার কমপ্লেক্সের ঘটনা।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা
বিশেষ পরিস্থিতিতে ম্যানহোলে মানুষ নামাতে হলে কী কী নির্দেশিকা মানতে হবে, বিশদে জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। বলা হয়েছিল, নিকাশি নালায় প্রাণঘাতী বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে কি না, সে সম্বন্ধে আগে নিশ্চিত হতে হবে। ম্যানহোলে নামার আগে সাফাইকর্মীদের কোমরে দড়ি বেঁধে দিতে হবে। তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাঁদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিশেষ অ্যাপ্রনে ঢাকতে হবে। বিশেষ ধরনের মুখোশ পরে ম্যানহোলে নামতে পারবেন সাফাইকর্মীরা। তাঁরা পায়ে গামবুট এবং হাতে দস্তানা পরে ম্যানহোলে নামবেন। লেদার কমপ্লেক্সের ঘটনায় কোনও নির্দেশিকাই মানা হয়নি বলে অভিযোগ। ২০২৩ সালে এই সংক্রান্ত একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে কোনও সাফাইকর্মীর মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারকে ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন
চার দিন আগের সতর্কতা
ম্যানহোলে মানুষ নামানোর কাজ বা ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ নিয়ে মাত্র চার দিন আগে কলকাতা-সহ দেশের ছয় শহরকে সতর্ক করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এবং হায়দরাবাদের প্রধান নির্বাহী কর্তাদের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত হলফনামা চাওয়া হয়েছে। ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা জমা দিতে হবে। ১৯ তারিখ শীর্ষ আদালতে এই সংক্রান্ত মামলার পরবর্তী শুনানি রয়েছে। আদালত জানতে চেয়েছে, এই শহরগুলিতে ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ বন্ধ করার জন্য কী পদক্ষেপ করেছে প্রশাসন। হলফনামা আকারে সেটাই জানাতে বলা হয়েছে।
দায় কার?
এই দুর্ঘটনার পরে আঙুল উঠছে প্রশাসনের দিকে। নর্দমা সাফাইয়ের দায়িত্ব বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া হয়ে থাকে। বড় নিকাশি নালার ক্ষেত্রে মূলত যন্ত্রের সাহায্যে সাফাই করা হয়। ছোট নর্দমাগুলির ক্ষেত্রে (যেগুলির উচ্চতা কোমরসমান) সংস্থাগুলি কর্মীদের ব্যবহার করে সাফাইকাজ করে থাকে। তবে সেই সব দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
কুঁদঘাটের ঘটনা
লেদার কমপ্লেক্সের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২১ সালে কুঁদঘাটের বিপর্যয়কেও। রিজেন্ট পার্ক থানা এলাকায় সদ্যনির্মিত ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশনের ম্যানহোলে নেমে জলের তোড়ে একসঙ্গে ভেসে গিয়েছিলেন সাত শ্রমিক। ম্যানহোল থেকে তাঁরা উঠছেন না দেখে এলাকার বাসিন্দারাই পুলিশ এবং দমকলকে খবর দেন। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে সাত জনকেই তুলে এনেছিল। কিন্তু তত ক্ষণে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গির আলম, মহম্মদ আলমগির, লিয়াকত আলি এবং সাবির হোসেন ছিলেন মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের বাসিন্দা। প্রত্যেকের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।