প্রতীকী ছবি।
প্রত্যন্ত বাংলায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের অভাবে দুঃস্থ পড়ুয়াদের ক’জন অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে এবং যারা পারছে না, তাদের বঞ্চনার প্রতিকার কী, সেটা করোনা-কালের অতি বড় প্রশ্ন। সেই সঙ্গেই প্রশ্ন উঠছে, নতুন ক্লাসের পড়ুয়াদের মূল্যায়ন হবে কী ভাবে?
অধিকাংশ স্কুলের প্রধান শিক্ষকই জানাচ্ছেন, তাঁরা অনলাইন পরীক্ষার পক্ষপাতী নন। কারণ, বহু ছাত্রছাত্রীই তো অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারছে না। অনলাইনে পরীক্ষা নিলে অধিকাংশ পড়ুয়া তাতে বসতে পারবে না। ফলে সকলের মূল্যায়ন হবে না। তৈরি হবে বৈষম্য। অনলাইন এড়িয়ে বিভিন্ন স্কুল অন্য যে-পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করছে, তা কতটা ঠিক এবং ছাত্রছাত্রীরা তাতে প্রকৃতপক্ষে কতটা উপকৃত হচ্ছে, উঠছে সেই প্রশ্নও।
মার্চের মাঝামাঝি করোনার দাপট যখন শুরু হয়, তত দিনে রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রায় তিন মাস ক্লাস হয়ে গিয়েছিল। সরকারি স্কুলে বছরে তিনটি সামেটিভ পরীক্ষা হয়। প্রথম সামেটিভ হওয়ার কথা ছিল এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু মার্চেই সব স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। অর্থাৎ এ বার কোনও মূল্যায়নই হয়নি।
আরও পড়ুন: অনলাইন পাঠ: পাশে ম্যাকাউট
মূল্যায়ন করা এ বার সত্যিই খুব কঠিন বলে মনে করছেন রাজ্য পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার। তাঁর মতে, পর্যাপ্ত পরিকাঠামো না-থাকায় রাজ্যের সব পড়ুয়ার অনলাইন পরীক্ষায় বসার সম্ভাবনা কার্যত নেই বললেই চলে। অভীকবাবু বলেন, “সকলে বসতে না-পারলে সেই পরীক্ষা নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? শিক্ষার অধিকার আইন খর্ব হচ্ছে। তাই আমরা নানা পদ্ধতিতে পড়ুয়াদের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছি। মিড-ডে মিলের সঙ্গে কিছু অ্যাক্টিভিটি টাস্ক দিয়ে জানার চেষ্টা করছি, পড়ুয়ারা কতটা শিখল।’’ কিন্তু এই মূল্যায়ন যে ক্লাসের পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে না, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়ে অভীকবাবু জানান, সমস্যা বেশি গ্রামাঞ্চলে, প্রত্যন্ত এলাকায়।
আরও পড়ুন: মুখে সব ভাষার কথা, শিক্ষামন্ত্রীর ভরসা হিন্দিতেই
ফলতার একটি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক পুলককুমার বসু বলেন, ‘‘আমাদের মতো গ্রামীণ এলাকার স্কুলে বেশির ভাগ পড়ুয়াই অনলাইন ক্লাসের সুবিধা পায়নি। অনলাইনে কিছু পড়ুয়া হয়তো পরীক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু যারা পারবে না, তাদের কী হবে? এতে পরীক্ষা-বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। অ্যাক্টিভিটি টাস্ক দিচ্ছি, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়।” আলিপুরদুয়ারের একটি স্কুলের শিক্ষক প্রসেনজিৎ রায়ের মতে, যাদের অনলাইন পরিকাঠামো আছে, শুধু তাদের পরীক্ষা নেওয়া অনৈতিক। কারণ সে-ক্ষেত্রে বাকিরা বঞ্চিত হবে। ‘‘আমাদের স্থানীয় কেব্ল চ্যানেলে কিছু শিক্ষক পড়িয়েছেন। পড়ুয়ারা ফোন করলে নানা ভাবে প্রশ্ন করে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, তারা কতটা বুঝতে পারছে, উত্তর দিতে পারছে কি না। কিন্তু এতেও বেশির ভাগ পড়ুয়ারই মূল্যায়ন হচ্ছে না।’’
শহরেরও বহু পড়ুয়া অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত বলে জানান কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘যাদের স্মার্টফোন আছে, তাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করে পরীক্ষা নিয়েছি। ওই পরীক্ষার্থীদের বলেছি, যারা হোয়াটসঅ্যাপে পরীক্ষা দিতে পারেনি, ফোনে যেন তাদের সব প্রশ্ন জানিয়ে দেওয়া হয়। প্রশ্ন জেনে পড়ুয়ারা উত্তর লিখে রাখলে স্কুল খোলার পরে আমরা তা দেখে দেব।’’ বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শাশ্বতী
অধিকারীও জানান, তাঁরা হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠাচ্ছেন ছাত্রীদের কাছে। হোয়াটসঅ্যাপেই উত্তর দিচ্ছে পড়ুয়ারা। ‘‘মেয়েরা বই দেখে উত্তর লিখছে কি না, সে-দিকে অভিভাবকদেরও একটু নজর রাখতে হবে। এটা মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি। পড়ুয়ারা কতটা শিখতে পারছে, সে-দিকে অভিভাবকদেরও দৃষ্টি দেওয়া দরকার,’’ বলেন শাশ্বতীদেবী।
মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি আবু তাহের বলেন, ‘‘অনলাইনে সকলের পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা মিড-ডে মিলের সঙ্গেই প্রশ্নমালা তৈরি করে দিচ্ছি। পরীক্ষায় গার্ড দিতে বলছি অভিভাবকদেরই।’’