লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে আবেদন করতে উপভোক্তাদের ভিড়। ছবি পিটিআই।
চলতি অর্থবর্ষের বাকি আছে ছ’মাস (সেপ্টেম্বর-মার্চ)। সেপ্টেম্বর থেকে এই ছ’মাসে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে প্রদেয় অর্থ সংগ্রহে বেগ পেতে হবে না, বুঝেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু পরের অর্থবর্ষ থেকে ওই প্রকল্পের বিপুল খরচ কী ভাবে চলবে, তা নিয়ে এখন থেকেই প্রশাসনিক স্তরে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বলে নবান্ন সূত্রের খবর।
যদিও গত বাজেটে সরকার জানিয়েছিল, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থের সংস্থান করাই আছে। রাজস্ব আদায় বা কেন্দ্রীয় করের ভাগ কাঙ্ক্ষিত হারে না-এলে অর্থের বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হতে পারে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ আধিকারিকদের অনেকে।
এই প্রকল্পে সাধারণ শ্রেণিভুক্ত গৃহবধূরা মাসে ৫০০ এবং তফসিলি জাতি ও জনজাতির মহিলারা ১০০০ টাকা অর্থসাহায্য পাবেন। প্রশাসনের অন্দরের অনুমান, উপভোক্তার সংখ্যা হতে পারে প্রায় দু’কোটি। সে-ক্ষেত্রে বছরে খরচ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা (সারণি দ্রষ্টব্য)। চলতি আর্থিক বছরের বাজেটের পরে সরকার জানিয়েছিল, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে ১০ হাজার কোটি টাকা ধরা আছে। প্রশাসনের অন্দরের সাম্প্রতিক খবর, সেই অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা ধরে রাখা হচ্ছে।
রাজ্যের বাজেট-নথিই বলে দিচ্ছে, আর্থিক বৃদ্ধির হার ১.২% হলেও রাজকোষের ঘাটতি প্রায় ৩.৮৬% এবং রাজস্ব-ঘাটতি ২.৫৪%। তার উপরে ঋণের সুদ-আসল মেটাতে হবে ৬৩,৭০০ কোটি টাকা। বেতন-পেনশন খাতে ধরে রাখতে হবে প্রায় ৮০,৪৩১ কোটি। আছে অন্যান্য সামাজিক প্রকল্প, যেগুলির বহর বা গুরুত্ব কম নয়। ‘টানাটানির সংসারে’ এই বিপুল অর্থ আসবে কী ভাবে, সেটাই বুঝতে চাইছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকে।
পাঁচালির পাতা
• বাজেটে বরাদ্দ: ১০ হাজার কোটি।
• উপভোক্তা অন্তত দু’কোটি। অর্ধেকই তফসিলি জাতি-জনজাতিভুক্ত।
• সাধারণ উপভোক্তা: মাসে ৫০০ টাকা।
• তফসিলি: মাসে ১০০০ টাকা।
• বছরে খরচ: প্রায় ১৮ হাজার কোটি।
যদিও অর্থ দফতর মনে করিয়ে দিচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এ বারের বাজেট ২.৫৫ লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৩.০৮ লক্ষ কোটি টাকা। কেন্দ্রের অনুদান আসবে ৫৬,৫৮৩ কোটি। রাজ্যের নিজস্ব কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭৫,৪১৫ কোটি। গত বছর বাজার থেকে ৫৬,৯৯২ কোটি টাকা ধার করা হয়েছিল। এ বার তা হতে পারে ৭৩,৬০৩ কোটি। রাজ্যের আশা, এ বছর মোট আয়ের পরিমাণ হতে পারে ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা।
অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘বাজেটে লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা ধরে রাখায় এই অর্থবর্ষে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে বা তার কাছাকাছি থাকলে এবং কেন্দ্রীয় করের বরাদ্দ ঠিকমতো পেলে পরেও তেমন সমস্যা হবে না। তবে এগুলি কাঙ্ক্ষিত হারে না-পেলে কী ভাবে ঘাটতি মেটানো যায়, তা ভেবে দেখতে হবে।” অর্থ দফতরের অন্য এক কর্তার বক্তব্য, সব ক্ষেত্রকে সমান গুরুত্ব দিয়েই অর্থনীতি পরিচালনার লক্ষ্য রয়েছে। বড় প্রেক্ষাপটে ভাবনাচিন্তা শুরু করার পরিস্থিতি এখনও আসেনি।
করোনা আবহে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, রঘুরাম রাজন থেকে গীতা গোপীনাথ— প্রত্যেকেরই বক্তব্য, মানুষের হাতে নগদের জোগান বাড়ানো গেলে তা বাজার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। রাজ্য সরকারও সেই পথে হাঁটতে চাইছে। তবে, গোটা দেশ তথা বিভিন্ন রাজ্যে এমন অনেক ‘জনমুখী’ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, যার আর্থিক সংস্থান নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। তাই অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মহিলাদের হাতে নগদ পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা খুবই যুক্তিযুক্ত। কারণ, মহিলারা প্রাপ্ত টাকার সদ্ব্যবহার করবেন সংসারের স্বার্থে। ফলে তার অপব্যবহারের আশঙ্কা খুব কম। তবে যে-রাজ্যে অনটন রয়েছে, সেখানে একটা সীমারেখা থাকা বাঞ্ছনীয়। শুধু তাঁদেরই টাকা পাওয়া উচিত, যাঁদের প্রকৃত অর্থে প্রয়োজন আছে। প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে আয়ের সীমা থাকলে সরকারি কোষাগারের উপরে চাপ কিছুটা হলেও কমত। প্রায় একই বক্তব্য বিরোধী শিবিরেরও।
প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার ব্যাখ্যা, মহিলাদের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প। সেখানে কার দরকার আছে আর কার নেই, সেটা সরকারের ঠিক করে দেওয়া উচিত নয়। সেই জন্য নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রের বাইরে প্রকল্পে আয়ের সীমারেখা নির্দিষ্ট করা হয়নি। প্রয়োজন না-থাকলেও প্রকল্পের সুবিধা পেতে আবেদন করবেন কি না, সেটা উপভোক্তার নৈতিক বিচার-বিবেচনার উপরে নির্ভর করছে।