প্রতীকী ছবি।
নতুন করে অতিমারির বাড়াবাড়ির মোকাবিলায় আজ, সোমবার থেকে আপাতত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার নির্দেশে সামগ্রিক ভাবে ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা বাড়লই। বিশেষত প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস ও পরীক্ষা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ভবিষ্যৎ কী হবে, উঠে গেল সেই প্রশ্ন।
শিক্ষা শিবিরের পর্যবেক্ষণ, শিক্ষার আলো ফুটি-ফুটি করে আবার স্তিমিত হয়ে যেতে বসেছে। অতিমারির প্রকোপ প্রশমিত হতে থাকায় নবম থেকে দ্বাদশের ক্লাস চলছিল অফলাইনে। স্কুলে অফলাইনে টেস্টও হয়ে গেল নির্বিঘ্নেই। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির ক্লাস কবে চালু হবে, সেই বিষয়ে আলোচনা চলছিল শিক্ষা শিবিরে। কিন্তু করোনার বাড়াবাড়িতে রাজ্য সরকার ফের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে আবার অনিশ্চয়তা ঘনিয়েছে। যদিও স্কুলে পাঠ্যপুস্তক, মিড-ডে মিলের সামগ্রী দেওয়া, টিকাকরণ প্রক্রিয়া, পরীক্ষার ফর্ম পূরণ চালু থাকবে বলে জানান শিক্ষা দফতরের এক কর্তা। চালু থাকবে স্কুলের প্রশাসনিক কাজও।
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন পরীক্ষাগুলি অনলাইনে নিতে হবে বলে আগেই অ্যাডভাইজ়রি বা পরামর্শ-নির্দেশিকা দিয়েছিল উচ্চশিক্ষা দফতর। শিক্ষা সূত্রের খবর, রবিবারের নির্দেশের পরে অনেক কলেজ-কর্তৃপক্ষ গ্রন্থাগারিকদের কলেজে যেতে বলছেন। রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (ওয়েবকুটা) সভাপতি শুভোদয় দাশগুপ্ত বলেন, “আগেও বলেছি, বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে প্রতি বারেই দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সহজ নিশানা। আগামী পৃথিবীর হিউম্যান রিসোর্স প্রায় দু’বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্বাসিত হয়ে বাড়িতে বসে আছে। মনোরোগ ও অবসাদের অতিমারি শুরু হতে পারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।’’ তাঁর দাবি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ না-করে সরকারি ও বেসরকারি অফিসের মতো ৫০%, প্রয়োজনে আরও কম ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্কুল-কলেজ চালু রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা উচিত। যদিও এখন ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে স্বচ্ছন্দ নন অভিভাবকদের একাংশ। শিক্ষা শিবিরের একাংশের প্রশ্ন, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে লোকাল চললে, ৫০% কর্মী নিয়ে সরকারি-বেসরকারি দফতর চলতে পারলে সমসংখ্যক বা তার চেয়েও কম ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্কুল-কলেজে পঠনপাঠন চালু রাখা যাবে না কেন?
শিক্ষকদের একাংশের প্রশ্ন, বর্ষ বিদায়, বর্ষবরণ, তার আগে পুজো, নির্বাচনে লাগামছাড়া হুল্লোড়ের জেরে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পথ প্রশস্ত করে এ বার সামাল দেবে কে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে দ্বাদশের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস হবে কী করে? কী ভাবেই বা ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বাদশের প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা হবে? ৭ মার্চ থেকে শুরু হতে যাওয়া মাধ্যমিক এবং ২ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া উচ্চ মাধ্যমিকের ভবিষ্যৎই বা কী? যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আপাতত ১৫ তারিখ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে, কিন্তু তাতে পড়ুয়াদের উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার অভিঘাত কিছুমাত্র কম হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভিমত।
সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক তরুণ নস্কর এ দিন বলেন, "এর জন্য সম্পূর্ণ ভাবেই দায়ী রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার। ১ জানুয়ারি রাজ্যের শাসক দলের প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়েছে। ১ জানুয়ারি থেকেই কেন্দ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সূর্যনমস্কার কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়েছে।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (জুটা) সাধারণ সম্পাদক পার্থসারথি রায় বলেন, "রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হল, লাগামছাড়া উৎসব পালন করা এবং উৎসব পালনে উৎসাহিত করা। তাতে শিক্ষা লাটে উঠলে উঠুক। সেই বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।“ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত দাসের অভিযোগ, "অতিমারি পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকা সত্ত্বেও কলকাতা ও কলকাতার বাইরে কার্যত সরকারি প্রশ্রয়েই একের পর এক উৎসবে অনাবশ্যক জনজোয়ার দেখা গিয়েছে।’’
শিক্ষক মহলের একাংশের মতে, সব থেকে দুর্ভাবনার মধ্যে পড়ে গেল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের একাংশের প্রশ্ন, তাদের লিখিত পরীক্ষা এপ্রিলে। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা হবে তো? পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসুর মতে, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠন বন্ধের নির্দেশিকা যেন কোনও ভাবেই এমন বার্তা বয়ে না-আনে যে, ২০২২ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।” অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেসসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতির কথায়, “পরীক্ষার্থী ও পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরকেই নিতে হবে।” ‘কলেজিয়াম অব অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার্স অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেসেস’-এর সম্পাদক সৌদীপ্ত দাসের বক্তব্য, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না-হলে টেস্টের মূল্যায়নের উপরে নির্ভর করে যদি নম্বর দেওয়া হয়, তা হলে ভাল ছেলেমেয়েরা খুবই আশাহত হবে। এই দুই পরীক্ষার বিষয়ে পরীক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তা দ্রুত দূর করা দরকার।
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে ফোন করা হলে তিনি এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য ফোন ধরেননি, মোবাইলে পাঠানো বার্তারও উত্তর দেননি।
তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি পার্থিব বসুর বক্তব্য, এই মুহূর্তে শিক্ষায়তন বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।