খুনীকে পাকড়াও করার পরে প্রেস কনফারেন্স করছেন পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার। নিজস্ব চিত্র।
রক্তমাখা একটা বিমার কাগজই যে জিয়াগঞ্জের তিন খুনের অন্যতম প্রধান সূত্র হয়ে উঠতে পারে, তা প্রথমে বুঝতে পারেননি তদন্তকারীরা। বন্ধুপ্রকাশ পালের মোবাইলের ‘কল ডিটেলস’ এবং ‘টাওয়ার ডাম্পিং প্রযুক্তি’ই ছিল এই তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশ এবং সিআইডির মূল হাতিয়ার।
কিন্তু, সেই প্রযুক্তি-নির্ভর তদন্তের উপর ভরসা করে কোনও ভাবেই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছিলেন না তদন্তকারীরা। তার একটা বড় কারণ, প্রতি দিন বন্ধুপ্রকাশের মোবাইলে কয়েকশো ফোন আসত। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার মঙ্গলবার বলেন,‘‘আমরা বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, সারাদিন মোবাইলে ব্যস্ত থাকতেন ওই শিক্ষক। এমনকি স্কুলে ক্লাস নেওয়ার সময়েও একের পর এক ফোন আসত।” ফলে বন্ধুপ্রকাশের মোবাইলের কল ডিটেলস ঘাঁটতে গিয়ে, ফোন নম্বরের ভিড়ে সূত্র খোঁজাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তদন্তকারীদের কাছে।
ঠিক একই ভাবে রক্তমাখা ওই বিমার নথি প্রাথমিক ভাবে কোনওদাগ কাটতে পারেনি তদন্তকারীদের চিন্তায়। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘বন্ধুপ্রকাশের গোটা ঘরেই বিভিন্ন রকমের বিমা, অর্থলগ্নির কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।ফলে আলাদা করে ওই বিমার কাগজকে গুরুত্ব দেননি গোয়েন্দারা। তবে, রক্ত মাখা থাকায় ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য ওই কাগজটি সংগ্রহ করা হয়।’’
আরও পড়ুন:জিয়াগঞ্জ কাণ্ডের কিনারা, ২৪ হাজার টাকার জন্য খুন, আততায়ী গ্রেফতার সাগরদিঘি থেকে
মুকেশ কুমার বলছেন, ‘‘প্রথম থেকেই ধারণা করেছিলাম, টাকাপয়সা সংক্রান্ত গন্ডগোলের জেরেই খুন। কারণ, আমরা এমন অনেককে পেয়েছি যাঁরা বন্ধুপ্রকাশকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।’’ কিন্তু জেলা পুলিশের এক তদন্তকারীর কথায়,‘‘ওই প্রতারিতদের মধ্যে থেকে খুনির হদিশ পাওয়া ছিল খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা।’’
আরও পড়ুন:জরুরি অবস্থা চলছে! ডেকে নিয়ে গিয়ে অপমান করা হয়েছে আমাকে: কার্নিভাল নিয়ে বিস্ফোরক রাজ্যপাল
সেই ফোন নম্বরের ভিড়ে হাতড়াতে হাতড়াতেই তদন্তকারীদের নজরে আসে উৎপলের নম্বর। জেলা পুলিশের এক তদন্তকারী আধিকারিক বলেন,‘‘ওটা আলাদা করে চোখে পড়ার কারণ, ওই নম্বর থেকে খুনের দিন সকালেও বন্ধুপ্রকাশেরমোবাইলে ফোন এসেছে। ৮ অক্টোবর ফোন করার সময় উৎপলের টাওয়ার লোকেশন ছিল জিয়াগঞ্জেই। কিন্তু ওই দিনের পর থেকেই টাওয়ার লোকেশন দেখা যায় সাগরদিঘির সাহাপুর।” পুলিশ ওই নম্বরটির কল ডিটেলস এবং টাওয়ার লোকেশন মেলাতে গিয়ে জানতে পারে, পুজোর আগে ওই মোবাইলের লোকেশন ছিল পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা। তারপরে সাগরদিঘি। সেখান থেকে নবমীর দিন অর্থাৎ ৭ অক্টোবর সেই মোবাইলের লোকেশন জিয়াগঞ্জ।
আরও পড়ুন: পাঁচ মিনিটে তিনজনকে কি একাই খুন করেছিল উৎপল? এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ
অন্যদিকে, সিআইডি-র আধিকারিকরা ততক্ষণে বন্ধুপ্রকাশের স্ত্রী বিউটির মোবাইল ঘেঁটে নিশ্চিত— খুন হয়েছে ৮ অক্টোবর বেলা ১২টা ৬থেকে ১২টা১১ মিনিটের মধ্যে। সেই অনুযায়ী ওই সময়ের আগে পরে এক ঘণ্টা ধরে টাওয়ার ডাম্প প্রযুক্তির ব্যবহারও করে সিআইডি। অর্থাৎ ওই সময়ে বন্ধুপ্রকাশের বাড়ি সংলগ্ন মোবাইল টাওয়ারের মধ্যে কারা কারা এসেছিলেন তাদের নম্বরের এক বিশাল তালিকা। এর আগে রানাঘাটের গির্জায় সন্ন্যাসিনী ধর্ষণ এবং লুঠের ঘটনায় ওই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছিল সিআইডি। সিআইডি সূত্রে খবর, টাওয়ার ডাম্পিংয়ে পাওয়া নম্বরের তালিকা থেকেও মেলে উৎপলের নম্বর।
বন্ধুপ্রকাশ পালের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র
আর তখনই তদন্তকারীদের মাথায় আসে, রক্তমাখা ওই বিমার কাগজের কথা। যেখানে উৎপল এবং তার বাবার নাম ঠিকানা লেখা ছিল। এর পরেই পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে, বন্ধুপ্রকাশকে নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে উৎপল এবং তার পরিবারের। মুকেশ কুমার এ দিন বলেন,‘‘আমরা মাধব বেহরা (উৎপলের বাবা) এবং তাঁর ছেলে উৎপলকে জেরা করে জানতে পারি যে, বিমার দ্বিতীয় বছরের প্রিমিয়ামের টাকা দেওয়ার পরেও কোনও রসিদ তাঁদের দেননি বন্ধুপ্রকাশ।” টাওয়ার লোকেশনের সূত্র ধরে আগেই পুলিশ জানতে পেরেছিল, উৎপল সাহাপুরের বাড়ি থেকে জিয়াগঞ্জ গিয়েছিল নবমীর দিন। ফিরেছিল খুনের দিন দুপুরে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে খুনের ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই। মাধববাবুর কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে, তাঁর মেয়ে পিঙ্কির বাড়ি জিয়াগঞ্জেই, বন্ধুপ্রকাশের বাড়ির কাছেই।
পুলিশ সূত্রে খবর, এর পরই জেরা করা হয় পিঙ্কিকে। সেখান থেকেই পুলিশ জানতে পারে, পিঙ্কির কাছ থেকে বন্ধুপ্রকাশের বাড়ির হদিশ জানতে চেয়েছিল উৎপল। পর পর পাওয়া ওই সূত্র জোড়া লাগাতেই পুলিশের হাতে আসে ‘জ্যাকপট’। প্রথমে অস্বীকার করলেও, শেষ পর্যন্ত উৎপল জেরায় খুনের কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার। তাঁর দাবি, পুজোর আগে এগরা থেকে বন্ধুপ্রকাশকে ফোন করেছিল উৎপল। সেই সময় বন্ধুপ্রকাশ গালিগালাজ করেন তাকে। তখনই বন্ধুপ্রকাশকে ‘শিক্ষা’ দিতে মনস্থ করে উৎপল এবং সাহাপুর থেকে নদী পেরিয়ে সদরঘাটে এসে সে ধারালো হাঁসুয়া কেনে। সে যে নদী পেরিয়ে আসাযাওয়া করেছে, তার ফুটেজও পুলিশ পেয়েছে ফেরিঘাটের সিসিটিভি দেখে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই রক্তমাখা হাঁসুয়া বন্ধুপ্রকাশের বাড়ির সামনেই পাওয়া গিয়েছে।