Arbitration meeting

পুরনো ব্যামো সালিশি সভা আগেও কেড়েছে বহু প্রাণ, ‘ভাল’ লক্ষ্য ‘খারাপ’ করেন কি রাজনীতির কারবারিরা?

সালিশি সভা নতুন বিষয় নয়। কিন্তু মাঝেমাঝেই সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। আইন তো বটেই, সাজা দেওয়ার অধিকার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার নজির নতুন করে লজ্জায় ফেলেছে বাংলাকে।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪ ১০:৩১
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সালিশি সভা বসিয়ে বিচারের নজির নতুন নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই গ্রামবাংলায় নানা সমস্যার সমাধান হয়েছে নানা ধরনের সালিশি সভায়। কখনও পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপ বা শিবমন্দিরের সামনে, কখনও পঞ্চায়েত দফতরে, কখনও বা পাড়ার ‘গণ্যমান্য’দের বাড়িতে। ক্লাবঘর, কাউন্সিলারের দফতরে বা থানায় ‘বড়বাবুর’ ঘরে সালিশি সভা বসার উদাহরণও আছে। অনেক সময়েই সেখানে ‘সুবিচার’ হয়েছে বলে দাবি করা হয়। আবার পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও কম নয়। তবে সালিশি সভা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার সাম্প্রতিক উদাহরণ ভাবাচ্ছে রাজনীতিকদেরও। আর এ ক্ষেত্রেও বাম বনাম অবামের লড়াই বেধেছে।

Advertisement

চোপড়ায় যুগলের নিগ্রহকাণ্ডে ধৃত তৃণমূল নেতা তাজিমুল ইসলামের নামে নিয়মিত সালিশি সভা বসানোর অভিযোগ উঠেছে। তিনি নিজে বিচার করে নিজের হাতেই সাজা দিতেন। সেই কারণেই সম্ভবত তিনি এলাকায় ‘জেসিবি’ নামে পরিচিত। তাঁর সাজার নমুনার একাধিক ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও সেই ভিডিয়োগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, নির্মম ভাবে তিনি পেটাচ্ছেন লোকজনকে।

শিলিগুড়ির লাগোয়া ফুলবাড়িতে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে স্বামীকে ছেড়ে এলাকার এক প্রতিবেশী যুবকের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন এক মহিলা। ফিরে আসতেই তিনি সালিশি সভার মুখোমুখি হন। ফুলবাড়ি এক নম্বর অঞ্চলের বকরাভিটা এলাকায় ক’দিন আগেই মাতব্বরেরা মহিলাকে মারধর করেন। সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন ওই মহিলা।

Advertisement

এই দু’টি সাম্প্রতিক ঘটনা রাজ্য এবং দেশ জুড়ে সাড়া ফেলেছে। চোপড়ার ঘটনা নিয়ে চাপানউতর চলছে সংসদেও। তবে অতীতেও এমন নজির কম নেই। গত জুন মাসে ফরাক্কার তোফাপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামে ছেলের বিয়ের কথা গ্রামবাসীকে না জানানোর ‘অপরাধে’ বসেছিল সালিশি সভা। সেখানে বিবাদ থেকে খুন হয়ে যায়। ২০২২ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের চাকিরহাটে দোকানে আগুন লাগানোর ঘটনায় গণৎকারের মাধ্যমে অভিযুক্তকে ‘দোষী সাব্যস্ত’ করে সালিশি সভা। এর পরে ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা জরিমানার নিদান দেওয়া হয় ‘দোষী’র পরিবারকে। শুধু তা-ই নয়, ওই পরিবারের জমির দলিলও মাতব্বরেরা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ।

চোপড়ায় সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত নেতার পক্ষে নেই তৃণমূল। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারও করেছে। সারা বছর সরকারের তরফে জনতাকে সচেতন করার প্রচারও চলে। কিন্তু সমাজের অনেক গভীরে রয়ে যাওয়া অসুখ মাঝেমধ্যেই প্রকাশ্যে এসে যায়। তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায়ের অবশ্য দাবি, সমস্যটা কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। সমস্যাটা ক্ষমতা প্রদর্শনের। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল বলে নয়, এটা হল শাসকের চেহারা। দল না চাইলেও এলাকাভিত্তিক শাসকদের দাঁত-নখ বেরিয়ে যায় মাঝে মাঝেই। যত ছোট জায়গায় হোক না কেন ‘এটা আমার এলাকা’ ভাবনাটাই মারাত্মক। এখানে আমার কথা শুনতে হবে! তাই তিনি নানা নিদান দিয়ে দেন। শাস্তির ভারও নিজের হাতে তুলে নেন।’’

তবে এই অসুখের জন্ম বাম আমলেই বলে দাবি নির্বেদের। তাঁর কথায়, ‘‘বামেদের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্যে পবিত্রতা ছিল না। সিপিএম পঞ্চায়েতকে দলীয় চেহারা দিয়েছিল। একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে নীচের তলা থেকে উপরে নিয়ে গেল। গান্ধীজি যে পঞ্চায়েতের কথা বলতেন, ধীরে ধীরে তার সঙ্গে হিংসা যোগ হয়ে গেল।’’ একই অভিযোগ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারেরও। তবে তিনি বামেদের থেকেও তৃণমূলকে এগিয়ে রেখেছেন। সুকান্ত বলেন, ‘‘বাম আমলের অত্যাচার ছিল বলে তৃণমূলের নির্যাতনও মেনে নিতে হবে, তা ঠিক নয়। শুধু বিজেপি করার কারণে তিন মহিলাকে রাস্তায় দণ্ডি কাটানো তো সালিশি সভার বিচারের মতোই।’’ পাশাপাশিই অধুনা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল আমলে সালিশি সভা একটা নতুন রূপ পেয়েছে। এখন দোষীকে আড়াল করার জন্যেও সালিশি সভা বসে। পুলিশ-প্রশাসনের মদতে অভিযোগকারীর উপরই নির্যাতন হয়।’’ বিজেপি নেতা প্রণয় রায়ের বক্তব্য, ‘‘শুধু গ্রামে নয়, শহরেও সালিশি সভা বসে। প্রতিটি পুরসভা এলাকায় ওয়ার্ড অফিসে সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা চলে। সেখানে মোটা অঙ্কের জরিমানাও হয়। বিরোধী দলের কর্মী, সমর্থকদের শায়েস্তা করার এমন কায়দা সব শহরেই ঘটে। এরও শুরুটা বাম আমলে।’’ প্রণয়ের অভিযোগ, হুগলির চন্দননগরে ‘সংযুক্ত নাগরিক কমিটি’ নামে সিপিএমের সংগঠন এখনও রয়েছে। যাদের কাজই পারিবারিক বিষয়ে নাক গলানো। এখন সেই দায়িত্ব তৃণমূল নিয়ে নিয়েছে।

তবে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘যাঁরা সালিশি নিয়ে বাম আমলের কথা বলছেন, তাঁরা হয় ইতিহাস জানেন না, বা জেনেও ইতিহাস বিকৃত করছেন।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘ব্রিটিশ আমলে ঋণ সালিশি বোর্ড ছিল। মহাজনের ঋণ শোধ দিতে না পারা, সুদের হার ইত্যাদি নিয়ে গ্রামের মান্যগণ্যেরা একসঙ্গে বসে মিটমাট করতেন। ফলে এর শুরু বাম জমানায় নয়। বরং, বাম জমানায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো মজবুত করা হয়েছিল।’’

সেলিম ইতিহাসের কথা বলেছেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা জানেন, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক থেকে সব বিষয়ে সিপিএমের ‘মাতব্বরি’ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। ২০০১ সালে দলের অভ্যন্তরীণ দলিলে (পার্টি চিঠি) উল্লেখ করা হয়েছিল, যে ভাবে স্থানীয় স্তরে নেতৃত্ব বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে, স্বামী-স্ত্রী, রেশন দোকানের লাইন ইত্যাদিতে নাক গলাচ্ছেন, তা বন্ধ করতে হবে।

তবে বাংলায় একটা সময় পর্যন্ত রাজনীতি ছাড়াই সালিশি চলত। পাড়ার ছোটখাটো সমস্যা এবং বিবাদে স্থানীয়েরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমাধান করতেন। বিবিধ অভিযোগের মীমাংসা হয়ে যেত চণ্ডীমণ্ডপ, পাড়ার রোয়াক বা ক্লাবের ঘরে। পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগিও হয়ে যেত। আদালতে না গিয়ে আলোচনা করে মিটিয়ে নেওয়া হত। পরে সমস্যা নিয়ে গ্রামের মানুষ পঞ্চায়েতেও যেতেন। কিন্তু মাতব্বরেরা তখনও আলাদা সালিশি সভা চালাতেন। যাতে হাত থেকে ক্ষমতা চলে না-যায়!

অভিজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, সেই পদ্ধতির কিছু ভাল দিকও ছিল। অনেকের মতে, পাড়ার বিচারে ভুলের সম্ভাবনা কম থাকত। কারণ, অভিযুক্ত এবং বিচারকারীরা পরস্পরকে দীর্ঘ দিন ধরে চিনতেন। ফলে একটা ধারণা থাকত। যা প্রমাণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। অভিযুক্ত এ-ও জানতেন যে, তাঁর হয়ে বলার জন্যও কেউ রয়েছেন। তবে কি সালিশি সভা একদা ‘ভাল’ লক্ষ্যে থাকলেও এখন ‘খারাপ’ হয়ে গিয়েছে? তৃণমূল নেতা নির্বেদের জবাব, ‘‘ভাল জিনিসেরই তো অপব্যবহার হয়। কারণ, ভাল কিছু করাটাই কঠিন।’’

অনেকে এমনও বলেন যে, আদালতের ‘দীর্ঘসূত্রিতা’ এড়াতে গ্রামীণ মানুষ এখনও সালিশি সভার উপর স্বেচ্ছায় ভরসা করেন। তা যে একেবারে অমূলক নয়, তা মেনে নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী কল্লোল বসু বলেন, ‘‘আদালতে গেলে যাঁর বিরুদ্ধে মামলা করছেন, তিনি ক্ষমতাশালী হলে আরও হেনস্থার শিকার হওয়ার ভয় থাকে। অনেকেই অর্থাভাবে আইনজীবী দিতে পারেন না। সরকারি আইনজীবী নেওয়ার পদ্ধতিও সকলের জানা থাকে না। তার জন্যও এই সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা চলতে থাকে।’’ ইদানীং কেন সালিশি সভার বিচার মর্মান্তিক হয়ে উঠছে? কল্লোলের ব্যাখ্যা, ‘‘যারা অত্যাচার করছে, তারাও একটা সময়ে গরিব ছিল। অসহায় ছিল। এখন রাজনৈতিক কারণে তাদের হাতে পয়সা আর ক্ষমতা এসেছে। সেই ক্ষমতার বলে শাসন করতে পারার মধ্যে একটা পৈশাচিক উল্লাস আর যৌন উন্মত্ততা কাজ করে।’’ তবে তাঁর মতে, নির্মমতার প্রধান কারণ সালিশি সভার পরিচালকদের শিক্ষার অভাব। তাঁর কথায়, ‘‘শিক্ষা ছাড়া ক্ষমতা ক্ষমা শেখায় না। যারা এটা করছে, তাদের কাছে ক্ষমা মানে দুর্বলতা আর কাপুরুষতা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement