প্রশিক্ষণ শিবিরে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (ডান দিকে) সঙ্গে লেখক।
দারিদ্র নিয়ে কাজের সূত্রেই আমার সঙ্গে অভিজিতের আলাপ। যে কাজটা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থনীতিতে সাফল্যের সঙ্গে করে চলেছেন, সেই কাজটা লিভার ফাউন্ডেশনের তরফে অনেক ছোট আকারে আমরা বীরভূমের গ্রামগুলিতে করার চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের কাজ ছিল ‘কোয়াক ডাক্তার’ অর্থাৎ গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকদের প্রশিক্ষিত করে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, এরই সূত্র ধরে বর্তমানে রাজ্য সরকার অপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটা করছে।
ওই কাজের সূত্রেই ২০১০ সালে অভিজিতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। আমরা বোঝার চেষ্টা করি যে আদৌ এই কাজের মাধ্যমে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি ঘটানো সম্ভব কি না। অভিজিৎ লিভার ফাউন্ডেশনের কাজে অংশগ্রহণ করেন। বীরভূমে চারটি ব্লকে ৩৩০ জন গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবককে নিয়ে একটা গবেষণা শুরু হয়। যার মধ্যে একটা অংশকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, আর অন্য অংশকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। আভিধানিক ভাষায় যাকে বলে ‘র্যানডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল’। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল যে, অভিজিৎ অর্থনীতিতে এই ‘র্যানডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল’-এর প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ এক দলকে একটা প্রশিক্ষণ দেওয়া হল, আর এক দলকে সেটা দেওয়া হল না। এ বার এই প্রশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিত দুই দল, তাঁদের মধ্যে ফলিত স্তরে তফাত কী হচ্ছে, সেটাই ছিল গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য। এটা এত দিন মূলত ছিল মেডিসিন গবেষণার অঙ্গ, কোনও ওষুধের কার্যকারিতা বোঝার জন্য এই কাজ করা হত, সেটাকে অভিজিৎ নিয়ে এসেছিলেন অর্থনীতিতে। সেটা জেনেই আমরা অভিজিতের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করি। শুরু হয় প্রশিক্ষণ। অভিজিৎ ও তাঁর সহযোগীরা সেই প্রশিক্ষণের ফলাফল গবেষণা করে দেখেন। এই গবেষণা রাজ্য সরকারের অর্থানুকূল্যেই হয়েছিল। আমি আর অভিজিৎ তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে-র সঙ্গে দেখাও করেছিলাম। মলয়বাবু গবেষণার ফল দেখে বুঝেছিলেন যে, গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকদের প্রশিক্ষণ দিলে তাঁদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাঁরা ভুল কাজ কম করেন এবং সঠিক পদ্ধতি মেনে চলার চেষ্টা করেন।
অভিজিতের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলাম যে, তিনি খুব খোলা মনে কাজ করতে ভালবাসেন। সমস্যা সমাধানের যে একটাই পথ, সেটা তিনি কখনও বিশ্বাস করেন না। চিন্তার বহুত্ব ও পথের বহুত্বে অভিজিৎ বিশ্বাসী। সেই সঙ্গে তিনি তর্ক
করতেও ভালবাসেন। তর্কের মাধ্যমে সত্যি কোনটা, তা খুঁজে বার করতে চান সব সময়ে।
আগামী ২২ অক্টোবর দিল্লিতে আমাদের একটি বৈঠক রয়েছে। সেই বৈঠকে অভিজিতেরও যোগদান করার কথা। যে কাজটা আমরা বীরভূমে করেছিলাম, সেই কাজটাই সারা দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রেক্ষিতে করা যায় কি না, সেটা নিয়েই আলোচনা হবে। আজ খবরটা জানার পর অভিজিৎকে ফোন করেছিলাম। ফোন করে বললাম, ‘‘দুর্ঘটনাটা একটু তাড়াতাড়িই ঘটে গেল!’’ শুনে উনি হাসলেন! আনন্দের এ রকম ‘দুর্ঘটনা’ আরও ঘটুক, আমরা শুধু এটাই চাই।
লেখক: লিভার ফাউন্ডেশনের সচিব