এক পাড়াতেই থাকলেও, তাঁরা পড়ার কেউ নয়। পাড়ার লোকেরাও সে কথা মনে করেন। মনে করেন মেসের বাসিন্দারাও।
জঙ্গিপুরে শ্রীপৎ সিংহ কলেজের ছাত্র রিজুয়ানুর রহমের মৃত্যুর পরে প্রশ্ন উঠেছে, মেসের বাসিন্দাদের সঙ্গে পাড়ার লোকের সম্পর্ক ঠিক কী রকম। বহরমপুর ও কৃষ্ণনগরের মতো শহরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া তরুণ-তরুণীদের একটি দল পাড়ার মধ্যেই থাকলে গৃহস্থ সব সময় স্বচ্ছন্দ থাকেন না। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা রমেন বসু বলেন, ‘‘বাড়ি থেকে ছাড়া পেয়ে অনেকে অসভ্যতা শুরু করে। সেটা সহ্য করা কঠিন। আবার কেউ কেউ খুবই গোবেচারা। তাদের প্রতি স্নেহ তৈরি হয়।’’ এই অম্লমধুর সম্পর্কটিই কোনও কোনও পাড়া টেনে চলে। পাড়ার বাসিন্দাদের বক্তব্য, ‘‘পাড়ার তো একটা চরিত্র থাকে। মেসের ছেলেদের সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই থাকে না। শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সামনেও সিগারেট ধরিয়ে ফোঁকে। সেটা খারাপ লাগে।’’ আবার সেই মেসের ছেলেটিই প্রয়োজনে পাড়ার কোনও বাড়ির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এমনও দেখা যায়।
কয়েক মাস আগে বহরমপুরের গোরাবাজার এলাকার একটি বাড়িতে গভীর রাতে আগুন লেগে যায়। ওই রাতে পাড়া-প্রতিবেশীর কারও সাড়া পাননি ওই পরিবার। শেষ পর্যন্ত মেসের ছেলেরা হাতে-হাতে বালতি ভর্তি জল নিয়ে গিয়ে আগুন আয়ত্তে আনে। ওই এলাকাতেই এক পরিবারের কর্তা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মেসের ছেলেরা ধরাধরি করে তাঁকে তিন তলার ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে। আবার সেই পাড়াতেই মেসের ছেলেদের কানে হেডফোন গুঁজে চলাফেরা করা বা রাত করে ঘরে ফেরা অনেকেই ভাল চোখে দেখেন না। পাড়ার গলির মোড়ে বা হস্টেলের গেটের সামনে কোনও ছাত্রীকে তার বন্ধুর মোটরবাইকের পিছনের আসন থেকে নামতে দেখলে, তা নিয়ে লোকজন ভ্রু-কুঁচকে তাকান। সব মিলিয়ে পাড়ার মানুষের কাছে মেস বাড়ি বা হস্টেলের আবাসিকরা ভিন গ্রহের কোনও প্রাণী। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন চর্যার বাইরে যেন আলোকবর্ষ দূরে তাদের অবস্থান—আর ওই ভাবনা থেকেই যাবতীয় জটিলতার সৃষ্টি। উভয় পক্ষের মধ্যেই সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়। গোরাবাজারের এমনই এক মেস বাড়ির আবাসিক শুভম ভাওয়াল বলেন, ‘‘পাড়ার মানুষের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। কলেজ যাওয়া-আসা, গৃহশিক্ষকের বাড়ি পড়তে যাওয়া, নিজের পড়াশোনার বাইরে সময় কোথায় পাই পাড়ার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার। রাতের খাওয়া শেষ করার পরে ঘরের আলো জ্বেলে আবাসিক বা সহপাঠীদের সঙ্গে কিছু ক্ষণ আড্ডা বা পড়াশোনা করে ঘুমোতে যাই। পর দিন ফের ধরাবাঁধা রুটিন।’’
কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক এমন ছিল না কয়েক বছর আগেও। টাইম কলে জল নিতে গিয়ে একে একে কত মানুষের সঙ্গেই না আলাপ হয়েছে সদ্য মেসে ঠাঁই নেওয়া এক ছেলের। এক সময় কলেজ শেষে পাড়ার ক্লাবে ক্যারাম পেটানো। পুজো মণ্ডপে ঢাকের তালে নাচ। এই ভাবে কোনও দিন যে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পড়তে আসা লাজুক ছেলেটাকে করিমপুর আপন করে নিয়েছিল, সেটা বোঝাই যায়নি। কলতলাতেই একদিন পাড়ার এক ছেলেকে টিউশন পড়ানোর পাকা কথা হয়। সেখান থেকে টিউশনে পসার জমে যাওয়া। তারপর মোড়ের চায়ের দোকানে পাড়ারই ছেলেদের সঙ্গে বসে সিগারেট আর চা ভাগ করে নেওয়া। করিমপুরের মেসের কথা মনে পড়তেই এমনই সব টুকরো টুকরো কথা মনে পড়ে যায় স্কুল শিক্ষক সৌরভ সরকারের। এখন তিনি করিমপুর থেকে দূরে। আসা হয় না। তবুও ফোনে নিয়িত যোগাযোগ। তিনি বলেন,‘‘করিমপুর থেকে কেউ ফোন করলে মনটা আজও চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনে হয় এক ছুটে চলে যাই।’’ গলাটা কিছুটা উদাস শোনায়। বলেন, ‘‘আসার আগে পাড়ার এক বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলছিলাম জানেন।’’ হয়ত আজও কাঁদেন। ‘‘এই দুঃখটাই আসলে মেসে থাকার মজা। সকলকেই এক সময় ছেড়ে যেতে হয়। কিন্তু জড়িয়ে থাকে সমস্ত সত্তার সঙ্গে।’’
ডোমকল এলাকা থেকে করিমপুর পান্নাদেবী কলেজে ভর্তি হয়েছিল সুরঞ্জন ঘোষাল। প্রথমে পাঁচ জন বন্ধু মিলে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে। পড়ে বাড়ে আরও দু’জন। নিজেদের মতোই মেস চালাতো তারা। পড়ার পাশাপাশি হাত খরচ চালাতে শুরু হয় টিউশন। তাও আবার পাড়ার দাদাদের হাত ধরেই। সেখান থেকে লিটল ম্যাগাজিন। আলাপ হয় পাড়ারই বাসিন্দা এক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে। বই পড়ার নেশা থেকে তার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত। একদিন আচমকা এই শিক্ষক প্রস্তাব দিলেন,‘‘ক’দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। বাড়িটা একেবারে ফাঁকা থাকবে। যা চোরের উৎপাত। তোরা এই ক’টা দিন একটু থাকতে পারবি।’’ ঘরে রঙিন টিভি। ফ্রিজ ভর্তি খাবার। ঠান্ডা জল।
সুরঞ্জন বলেন, ‘‘ভাবুন একবার। আমরা কটা বাইরে থেকে আসা ছেলে। তাদের হাতে কিনা তুলে দিয়ে গেলেন গোটা বাড়ির চাবি। কতটা বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি না হলে এটা সম্ভব।’’ ২০ বছর ধরে মেস চালিয়ে আসার পরে সুজিত বিশ্বাসও বলছেন, ‘‘জানেন আমিই ছেলেদের ‘লোকাল গার্জিয়ান’। বাড়ির লোকরা যে আমার হাতেই তাদের তুলে দিয়ে গিয়েছে।’’
কাঁঠালপোতা মেয়েদের মেসে চাকরিজীবীদের পাশাপাশি বেশ কিছু ছাত্রীও থাকে। পাড়ার ছেলেরা আছেন বলেই তো নিশ্চিন্তে থাকেন মেসের মালিক কৃষ্ণা বিশ্বাস। রাতে টিউশন নিয়ে ফেরার পথে পাড়ার রাস্তায় যাতে কোন সমস্যা না হয়, কিংবা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার ডাক পড়ে পাড়ার ছেলেদের। এই মেসের মালিক কৃষ্ণাদেবী বলেন, ‘‘সে বার তো রাত বারোটার সময় একটা মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল। পাড়ার ছেলেগুলো ক্যারাম খেলছিল। ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল আমাদের সঙ্গে।’’
তবে সর্বত্রই যে একেবারে একই রকম চিত্র তাও বলা যাবে না।
গোরাবাজার শান্তি গার্লস ও বয়েজ হস্টেল মালিক ইকবাল কাশেম বলেন, ‘‘দুটি হস্টেল মিলিয়ে ছ’শো আবাসিক রয়েছেন আমাদের। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়েই দুটি হস্টেল চালাই। আবাসিকদের সম্বন্ধে পাড়ার লোকজনের কখনও কোনও অভিযোগ থাকলে তাঁরা আমাদের জানান। আমরা দ্রুত সেই সমস্যা মিটিয়ে দিই।’’ ওই আবাসিকরা উদ্যোগ নিয়ে প্রতি বছর হস্টেলে ঘটা করে সরস্বতী পুজো করে থাকে। সেই পুজোর প্রসাদ থেকে ভোগ পাড়ায় বিতরণ করেন তাঁরা।
কিন্তু সমস্যা সেই পাড়ার ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া করা নিয়েই। মেসের বাসিন্দা পায়েল সিংহ শ্রাবন্তী হালদার, চিত্রা রায়, চঞ্চলা হালদার, তৃপ্তি সিংহ, দুলালি খাতুনদের কথায়, ‘‘পাড়ার মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভাল। তবে সকলেই যে আমাদের ভাল চোখে দেখেন তাও নয়। আবার অনেক আবাসিকের আচরণও তো সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। ফলে পাড়ায় ফিসফাস হয়। সেখান থেকেই দূরত্ব বাড়ে।’’
রানিবাগানের বাসিন্দা মৌসুমী মিত্র বলেন, ‘‘ছেলেদের মেস থেকে রাত-বিরেতে মদ্যপ হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি তো হয়। এমনকী জোরে গান বাজিয়ে পার্টিও করে তারা। অনেক সময়ে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।’’
ইকবাল জানান, এখন পাড়ায় পাড়ায় মেস বাড়ি গড়িয়ে উঠেছে। এখন ঘর ভাড়া দিয়েই এক শ্রেণির বাড়ির মালিকদের মধ্যে দায় এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা কাজ করে। ফলে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে কলেজ পড়ুয়াদের ঘর থেকে বিয়ার বা মদের বোতল থাকবে না, সিগারেট খেয়ে পোড়া অংশ জানালা দিয়ে ফেলবে না, চিৎকার-চেঁচামেচি করবে না, তা হয় না। পাড়ার মানুষ তখনই ওই অত্যাচার সহ্য করবেন যদি সম্পর্ক ভাল রাখা যায়। সেই সম্পর্ক রাখার দায় বাড়ির মালিকের।