দলীয় সদস্যদের নামে নামে খাম পাঠাল জেলা কমিটি। —গ্রাফিক আনন্দবাজার অনলাইন।
কৌটো নাড়ানো এখনও অতীত হয়ে যায়নি। পাশাপাশি, দলে অনেক দিনই চালু হয়েছে ‘কুপন’ ব্যবস্থা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগ হয়েছে কালো বর্গাকার ‘কিউআর কোড’ও। অর্থসংগ্রহের এই তিন ‘ক’-এর পরে এ বার সিপিএম ‘খ’-এ প্রবেশ করল। ‘খ’-এ খাম। সৌজন্যে: দলের হুগলি জেলা কমিটি। উপলক্ষ: দলের রাজ্য সম্মেলন। বহু যুগ পর কলকাতা থেকে বেরিয়ে এ বার হুগলির ডানকুনিতেই বসছে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন।
ফেব্রুয়ারি মাসের ২২-২৫ তারিখ সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন বসছে হুগলির ডানকুনিতে। সেই কর্মসূচি সফল করতেই জেলার প্রায় ১৫ হাজার পার্টি এবং সহায়ক গ্রুপের (এজি) সদস্যের খাম পাঠিয়েছে জেলা কমিটি। পার্টি সদস্যদের নামে নামে সেই খাম তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন স্থানীয় স্তরে এরিয়া এবং শাখা নেতৃত্ব। দলীয় সদস্যদের বলা হয়েছে, সেই খামে তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা জেলা কমিটিকে দেওয়ার জন্য। যা সিপিএমের অভিধানে ‘অভিনব’। অতীতে এমন খামে টাকা পাঠানোর রেওয়াজ দলে ছিল না।
কিন্তু কেন ‘ক’ থেকে ‘খ’-এ যেতে হল? সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক তথা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দেবব্রত ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা পার্টি সদস্য এবং সহায়ক গ্রুপের সদস্যদের ওই খাম দিয়েছি, যাতে তাঁদের পরিবারকেও আমরা শামিল করতে পারি। দেখা যাচ্ছে, ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে পার্টি সদস্যেরা তাঁদের পরিবারকে যুক্ত করে খামে সাধ্যমতো অর্থ পাঠাচ্ছেন।’’ দেবব্রত কম বয়সে জেলা সম্পাদক হয়েছিলেন। এই নিয়ে তৃতীয় মেয়াদের জেলা সম্পাদকের দায়িত্বে তিনি। তবে সিপিএমের ‘ট্র্যাডিশনাল’ নেতাদের ব্যাকরণ মেনেই সব কথা খোলসা করেন না। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খাম পাঠানো হয়েছে পার্টি সদস্যদের। কী সেই দৃষ্টিভঙ্গি? হুগলি জেলা সিপিএমের এক তরুণ নেতার কথায়, ‘‘ভোট বা বড় সম্মেলন হলে সাধারণত পার্টি সদস্যদের উপর হুইপ জারি করা হয় এক বা দু’দিনের আয় দলকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এ বার সেই পদ্ধতি নেওয়া হয়নি। বরং কোনও নির্দেশ না দিয়ে দেখা হচ্ছে, কে কত টাকা দিচ্ছেন। কারা সংস্থান থাকা সত্ত্বেও পার্টিতে টাকা দিচ্ছেন না, আবার কারা অভাবের মধ্যেও সাধ্যের চেয়ে বেশি দিচ্ছেন।’’ অর্থাৎ, খামের ভিতর শুধু টাকা গুনবে না সিপিএম। দল দেখতে চাইছে, কী খেয়ালে খামে টাকা দিয়েছেন দলীয় সদস্যেরা।
প্রসঙ্গত, সিপিএমের মধ্যে এই আলোচনা রয়েছে যে, দলীয় সদস্যদের আয় গোপনের প্রবণতা বাড়ছে। সিপিএমের দলীয় সদস্যপদ রাখতে গেলে আয়ের ভিত্তিতে দলকে প্রতি মাসে চাঁদা দিতে হয়। যাকে দলীয় পরিভাষায় বলা হয় ‘লেভি’। কত আয়ে কত শতাংশ ‘লেভি’ দিতে হবে, তা দলের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু সিপিএম সূত্রের খবর, গত কয়েক বছর ধরেই দলীয় সদস্যদের একাংশের মধ্যে প্রকৃত আয় গোপন করার প্রবণতা বাড়ছে। সেই প্রবণতা শহর-মফস্সলে বেশি বলে খবর। যদিও, তারও ‘বাস্তব’ কারণ রয়েছে বলে মানছেন নেতারা।
এ হেন প্রেক্ষাপটে রাজ্য সম্মেলনের বিপুল খরচ সামলাতে দলীয় সদস্যদের ‘চাপ’ না দিয়ে ‘স্বতঃস্ফূর্ততার’ উপর ছাড়তে চেয়েছে দল। হুগলির এই পদক্ষেপ প্রসঙ্গে রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘আমাদের পার্টির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা চাপিয়ে দেওয়া নয়। তা স্বেচ্ছাশৃঙ্খল। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হুগলির এই পদক্ষেপ সাধুবাদযোগ্য।’’
ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর বহু জেলাতেই সিপিএম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। বহু জেলা কমিটির এক সময়ে একাধিক গাড়ি ছিল। কিন্তু সময়ের তাগিদে অনেক জেলা গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে খরচ সাশ্রয়ের পথে হেঁটেছে। সেই তালিকায় রয়েছে হুগলিও। আবার অনেক জেলায় আর্থিক সঙ্কটের কারণেই সর্বক্ষণের কর্মী (হোলটাইমার) নিয়োগের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। এই তালিকায় আবার হুগলি নেই। কারণ, এই জেলায় ধারাবহিক ভাবে সর্বক্ষণের কর্মীদের নিযুক্ত করেছে তারা। তবে রাজ্য সম্মেলনের খরচ যে বিপুল, তা মানছেন সকলেই। সম্মেলনের জন্য কোনও প্রেক্ষাগৃহও পায়নি সিপিএম। ডানকুনির একটি খোলা জায়গায় হ্যাঙার টাঙিয়ে হবে সেই সম্মেলন। ফলে খরচ আরও কিছুটা বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও খামেই ভরসা রাখছে সিপিএম। কারণ, খামের ভিতরেই খেয়াল ধরবেন নেতারা।