প্রতীকী ছবি।
হাতে কালো বাক্স। গলায় স্টেথোস্কোপ। চলাফেরায় হন্তদন্ত ভাব। দুয়েক দশক আগেও তাঁদের দেখা যেত হামেশাই। তাঁরা সকাল-বিকেল বাড়িতে এসে রোগী দেখে যেতেন, চা খেতেন। রোগীর বিছানার পাশে পাতা চেয়ারে বাড়ির লোক যাঁদের শশব্যস্ত হয়ে বসাতেন। ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। ডাক্তারবাবুদের এই ‘হোম-কল’ এর এই প্রচলিত অভ্যাস কার্যত অতীত হয়ে গিয়েছে। আর তাতেই সমস্যায় পড়ছেন বহু রোগী ।
গত সপ্তাহের কথা। নেতাজিনগর অঞ্চল থেকে একটি ফোন গিয়েছিল স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে। বাড়িতে একা থাকা বৃদ্ধ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাশের বাড়ির আর এক বৃদ্ধ দম্পতি পরপর তিন জন চিকিৎসককে বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে শেষে ওই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
মাসখানেক আগে বাগবাজারের বাড়িতে আচমকা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান বছর ছত্রিশের এক যুবক। বাড়িতে এসে তাঁর মৃতদেহ পরীক্ষা করে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ দেবেন, এমন চিকিৎসক বহু চেষ্টাতেও জোগাড় করতে পারেনি পরিবার। শেষ পর্যন্ত কাছাকাছি এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তারা জানায়, ময়না-তদন্ত না করে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না। সেটাই করতে হয়।
কাঁকুড়গাছির বাসিন্দা সাতাত্তর বছরের অনুরূপা রায়প্রধান বার্ধক্যজনিত রোগে বছর দুয়েক শয্যাশায়ী। মাঝেমাঝেই সমস্যা বাড়ে। চিকিৎসক পরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিলেই নিরাময় হয়। কিন্তু বাড়িতে আসবেন এমন চিকিৎসক পাওয়া দুষ্কর। এ দিকে, তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোনও চেম্বারে বা হাসপাতালে গিয়ে অপেক্ষা করে ডাক্তার দেখানো ওই বৃদ্ধার পক্ষে কার্যত অসম্ভব।
এই সুযোগেই কলকাতা-সহ বিভিন্ন শহরে এখন টাকার বিনিময়ে ফোন করলেই বাড়িতে ডাক্তার পাঠানো, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিষেবা নিয়ে রমরমে ব্যবসা চালাচ্ছে বিভিন্ন ‘স্টার্ট আপ এজেন্সি’।
কিন্তু ডাক্তারবাবুদের বাড়িতে যেতে এই অনীহা কেন?
পাড়ায়-পাড়ায় চেম্বার করা জেনারেল ফিজিশিয়ানদের সংখ্যা কমে যাওয়া, কর্পোরেট হাসপাতালের কমিশনের সংস্কৃতি— এ সব কারণকে দায়ী করেছেন অনেকে। চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী এর সঙ্গে যোগ করেছেন ডাক্তার-রোগীর ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্ক। ‘‘বাড়ি গিয়ে রোগী দেখলে যে বাড়তি দায়িত্বটা চিকিৎসকের উপর এসে পড়ে সেটাই তাঁরা নিতে চাইছেন না। রোগীর আত্মীয়রা ফোন করে কিছু জানতে চাইলে ‘হ্যাপা’ বলে
মনে করছেন।’’
অনেক বলছেন, আসলে সমাজের কাঠামোটাই এখন বদলে গিয়েছে। মূল্যবোধ পাল্টেছে। আগে পাড়ার ডাক্তাররাই হোম কল-এ যেতেন। প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তার ভিতরে কোনও অতিরিক্ত চাপ বা ভয় ছিল না। তা ছাড়া, ডাক্তারদের অনেকে এখন মনে করছেন, হোম কল-এ যত ক্ষণে এক জন রোগী দেখবেন তত ক্ষণে চেম্বারে ৪ জনকে দেখে বেশি রোজগার করা যাবে— মত পার্থ প্রধান ও অরুণাংশু তালুকদারের মতো চিকিৎসকদের।
গাঙ্গুলিবাগান এলাকার চিকিৎসক প্রবীর বিশ্বাস এখনও দিনে ৪-৫টি হোম কল-এ যান। তবে তিনিও বলছেন, ‘‘এখন যা পরিস্থিতি, তাতে বিপদের ভয়েই ডাক্তারেরা হোম-কল এড়িয়ে যান।’’ বাড়িতে চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে যে ধৈর্য ও সহযোগিতা রোগীর পরিবারের তরফে মিলত, এখন সেটা আর নেই বলে মনে করেন চিকিৎসক হিমাদ্রি দত্তও।
তবে নব্বই বছরের ‘বিশু ডাক্তার’ এর মতো কয়েক জন রয়েছেন। ১৯৫৫ সাল থেকে তিনি প্র্যাকটিস করেন বীরভূম লাভপুর গ্রামে। ভাল নাম সুকুমার চন্দ্র। আগে মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে দিনে ৭-৮টি বাড়িতে কল-এ যাওয়া ছিল বাঁধা। এখনও টোটো চেপে দিনে অন্তত দু’টি কল-এ যান। ‘‘এত দিনের অভ্যাস বন্ধ করা যায় না। তা ছাড়া, আমার মানুষের উপর এখনও বিশ্বাস আছে। মার খাওয়ার ভয় নেই’’— হেসে বলেন তিনি।
রোগী-ডাক্তারের মাঝে ভেঙে যাওয়া বিশ্বাসে যেন সেতু হয়ে দাঁড়ায় নব্বই পেরোনো চিকিৎসকের সেই ভরসার হাসি।