সবং কলেজে ছাত্র খুনের তদন্ত নিয়ে নিম্ন আদালতে তিন-তিন বার তিরস্কৃত হয়েছে পুলিশ। সেই মামলায় এ বার কলকাতা হাইকোর্টও পুলিশকে তুলোধোনা করল। হাইকোর্ট সোমবার এ প্রসঙ্গে পুলিশকে ব্যর্থ ও অকর্মণ্যের তকমা তো দিয়েইছে, সেই সঙ্গে তুলে দিয়েছে প্রশ্ন— পুলিশ কি শুধু বাছাই করা লোকজনকেই গ্রেফতার করছে?
সবং-মামলায় ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ পুলিশি তদন্তের অভিযোগ অবশ্য কংগ্রেসের তরফে আগেই তোলা হয়েছে। যার প্রতিকার চেয়ে মানস ভুঁইয়া-সহ একাধিক কংগ্রেস নেতা ধর্মতলায় অনশনও শুরু করেছিলেন। এ দিন আদালতের মন্তব্য শোনার পরে তাঁরা অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ‘‘আইনের উপরে আমাদের আস্থা রয়েছে। আমরা গোড়া থেকেই বলে আসছিলাম, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তদন্ত চলছে।’’— প্রতিক্রিয়া মানসবাবুর।
গত ৭ অগস্ট সবং সজনীকান্ত কলেজের ছাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ জানাকে কলেজ চত্বরে পিটিয়ে খুন করার অভিযোগ ওঠে। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছিল, কলেজে ছাত্র সংসদের দখলদারি ঘিরে গোলমালের জেরেই কৃষ্ণপ্রসাদের প্রাণ গিয়েছে। এবং ছাত্র পরিষদের (সিপি) ওই সমর্থককে হত্যার ঘটনায় আঙুল উঠেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) দিকে।
কিন্তু তদন্তে নেমে সংশ্লিষ্ট পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ যে সাত জনকে গ্রেফতার করে, তাঁদের তিন জন টিএমসিপি’র সদস্য হলেও বাকি চার জন সিপি’র! এমনকী, সিপি’র যে নেতা কৃষ্ণপ্রসাদের মৃত্যু সংক্রান্ত অভিযোগটি দায়ের করেছিলেন, সেই সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়কেও গ্রেফতার করে জেলা পুলিশ।
ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ আসল অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে কিনা, সেই সংশয়ে আলোড়িত হয় রাজ্যের শিক্ষা ও রাজনীতির জগৎ। যে ধন্দ জোরালো হয়েছে পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে। কী রকম?
ঘটনার একচল্লিশ দিনের মাথায় মেদিনীপুর মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের (সিজেএম) এজলাসে পুলিশের দাখিল করা ওই চার্জশিটে মোট ২১ জনের নাম ছিল। তাঁদের ১৯ জনই সিপি-র ছেলে! ধৃত টিএমসিপি কর্মীদের মধ্যে অসীম মাইতির নাম চার্জশিটে রাখাই হয়নি। উপরন্তু সিপি কর্মীদের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারা প্রযুক্ত হলেও টিএমসিপি’র ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে জামিনযোগ্য ধারা!
পুলিশি তদন্তের রকম-সকম দেখে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়। হেমন্ত মিশ্র নামে এক আইনজীবীর দায়ের করা মামলাটির আবেদন, সবং কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত হোক। এ দিন প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানির শুরুতে রাজ্য সরকারের কৌঁসুলি (গভর্নমেন্ট প্লিডার, সংক্ষেপে জিপি) অভ্রতোষ মজুমদারকে আদালত বলে, তদন্তে কী কী অগ্রগতি হয়েছে, আগামী সোমবারের মধ্যে তার রিপোর্ট চাই। অন্য দিকে অভ্রতোষবাবু আদালতকে জানান, তিনি এ দিনই রিপোর্ট জমা দিয়ে দেবেন। তিনি এ-ও বলেন, মামলায় অতিরিক্ত হলফনামা জমা দিয়েছেন বুদ্ধদেব মিশ্র (সবংয়ের ছাত্র পরিষদ নেতা) নামে এক অভিযুক্ত, যিনি কিনা পুলিশের খাতায় ফেরার!
জিপি-র কথা শুনে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তীব্র বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করে। খুনের মামলায় অভিযুক্ত প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ পুলিশ তাকে ধরতে পারছে না, এমন কাণ্ডকে পুলিশের ব্যর্থতা হিসেবে অভিহিত করেন বিচারপতিরা। তাঁদের কথায়, ‘‘অভিযুক্ত কোর্টে আসছে, হলফনামা দিচ্ছে, কিন্তু পুলিশ ধরতে পারছে না! অকর্মণ্যতা ছাড়া একে কী বলা যায়?’’
পাশাপাশি গ্রেফতারির ‘চরিত্র’ নিয়েও হাইকোর্ট সন্দিহান। তাদের প্রশ্ন— পুলিশ বেছে বেছে লোকজনকে ধরছে না তো? ‘‘যাকে ধরব মনে করছে তাকে ধরছে, যাকে মনে করছে না, তাকে ধরছে না?’’— মন্তব্য বেঞ্চের। মামলা যাতে অন্য তদন্তকারী সংস্থার হাতে না যায়, সেই লক্ষ্যে পুলিশ ঢাল হিসেবে গ্রেফতারির বিষয়টিকে ব্যবহার করছে কি না, হাইকোর্ট সেই সংশয়ও প্রকাশ করতে ছাড়েনি।
ডিভিশন বেঞ্চের তোপের মুখে জিপি কার্যত নীরবই থাকেন। তবে তদন্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত রিপোর্ট ও চার্জশিটের প্রতিলিপি তিনি এ দিন কোর্টে জমা দিয়েছেন।
মামলাটির সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই পর্যবেক্ষণ: পুলিশি তদন্তের ফাঁকফোকর মেদিনীপুর কোর্টেই বারবার সামনে এসেছে। যেমন, ধৃত সিপি কর্মীদের কৌঁসুলিরা গত ১ সেপ্টেম্বরের শুনানিতে অভিযোগ তুলেছিলেন, খড়্গপুরের এসডিপিও সিপি-র ছেলেদের বাড়ি গিয়ে মা-বাবাকে ভুল বোঝাচ্ছেন, কিন্তু তদন্তকারী অফিসার (আইও) সঙ্গে যাচ্ছেন না! এমনকী, ধৃত সিপি-কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খোদ এসপি-র অফিসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! অভিযোগ শুনে আইও বিশ্বজিত্ মণ্ডলকে সতর্ক করে দেয় আদালত। বিচারক এ-ও মন্তব্য করেন, “আইও-র নাম ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছে! সামনে চলে আসছে অন্য কারও (ঊর্ধ্বতন অফিসারের) নাম!”
এর চার দিন বাদে তদন্তের নথি নিয়ে কোর্টের ভর্ৎসনা শুনতে হয় জেলা পুলিশকে। কেস ডায়েরি (সিডি) দেখাকালীন বিচারক অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন, “সব নথির ক্রমিক সংখ্যা নেই কেন? এমন অসম্পূর্ণ সিডি দেবেন না।” পুলিশি হেফাজতে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত নথি সিডি’তে নেই কেন, তারও সদুত্তর আইও সে দিন দিতে পারেননি।
আরও আছে। সৌমেনের কৌঁসুলিরা ১৮ সেপ্টেম্বরের শুনানিতে জানতে চেয়েছিলেন, যাঁর (সৌমেনের) অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের মামলা রুজু হল, তাঁকে না-জানিয়ে চার্জশিট পেশ হয় কী করে? সরকারের কৌঁসুলি বলেন, আইও সৌমেনকে নোটিস পাঠানোর আর্জি জানিয়েছেন। আর্জিটি সে দিন মঞ্জুরও করে আদালত। কিন্তু সরকারপক্ষ পর দিন (১৯ সেপ্টেম্বর) সুর বদলে আর্জি জানায়, নোটিস পাঠানোর নির্দেশ সংশোধন করা হোক। ‘‘কারণ, সৌমেন ধৃত ও অন্যতম অভিযুক্ত।’’— যুক্তি দেন সরকারি কৌঁসুলি।
শুনে আদালত ক্ষোভ গোপন করেনি। ‘‘কাল আইও যখন নোটিস পাঠানোর আবেদন করলেন, তখন সৌমেন ধৃত বা অভিযুক্ত ছিলেন না?’’— প্রশ্ন তোলেন বিচারক। জবাবে সরকারি কৌঁসুলির স্বীকারোক্তি, “আইও ভুল করে ফেলেছেন।”
‘ভুল’ শোধরানোর আর্জি বিচারক পত্রপাঠ খারিজ করে দেন। একটি তদন্ত ঘিরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ বারবার মুখ পোড়ানোয় রাজ্যের
পুলিশের একাংশ অবশ্য আদৌ বিস্মিত নন। তাঁদের ব্যাখ্যা: ওই জেলার এসপি ভারতী ঘোষ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু অফিসার শাসকদলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সম্যক পরিচিত। তাই বিরোধী সংগঠনের ছাত্রকে খুনের তদন্তে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠতেই পারে। ছাত্র পরিষদের রাজ্য সহ-সভাপতি মহম্মদ সইফুলের মন্তব্য, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সিপি কর্মীদের নাম জড়ানো হয়েছে। টিএমসিপি-র ছেলেদের বাঁচাতে পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।’’ আর মানসবাবুর কটাক্ষ, ‘‘ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী ন’শো কিলোমিটার দূরে বসে বলে দিয়েছিলেন, এ সব নাকি ছাত্র পরিষদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল! তাঁর প্রিয় এসপি সেই মতো মামলা সাজিয়ে মিথ্যে চার্জশিট দিয়েছেন।’’
পুলিশ কী বলছে?
ভারতী ঘোষের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর মোবাইল বেজে গিয়েছে, এসএমএসের জবাব আসেনি। জেলার অন্য কোনও পুলিশকর্তা হাইকোর্টের মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। তবে এক কর্তা বলেন, ‘‘ওই অভিযুক্তের (বুদ্ধদেব মিশ্র) নামে পরোয়ানা জারি হয়েছে। তাঁর খোঁজ চলছে।’’