স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘স্বাস্থ্য’ ফেরাতে কড়া ‘ডোজ’-এর নিদান ছিল নবান্নের। তা পালন করেছে স্বাস্থ্য ভবন। এবং ফলাফল বলছে, ধাত বদলে কাজ হচ্ছে।
২০১৮ সালের প্রথম পাঁচ মাসের তৃণমূলস্তরের স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মহকুমা হাসপাতাল, স্টেট জেনারেল, গ্রামীণ এবং জেলা হাসপাতালগুলি থেকে চিকিৎসা না করে নানা অছিলায় রোগী অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ার হার কমে প্রায় অর্ধেক হয়েছে। ২০১৭-এ জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত জেলা হাসপাতালগুলি থেকে নানা কারণে অন্য হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে(রেফার) দেওয়ার হার ছিল ৯.১১% । ২০১৫ এবং ২০১৬-এর প্রথম পাঁচ মাসে এই হার ছিল ৯.২৮% এবং ৯.৯৯%। ২০১৮-এর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত রোগী পাঠানোর হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৭%। স্বাস্থ্য ভবনের মতে, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার একটি সূচকই বলে দিচ্ছে জেলা স্তরে চিকিৎসার হাল বদলাচ্ছে।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কথায়,‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরদারির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে, স্বাস্থ্য পরিষেবাই রাজ্য এখন সেরা।’’
পরিষেবার মান ভাল বোঝাতে কেন এমন একটি সূচককেই বড় করে দেখাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর?
স্বাস্থ্য কর্তারা জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে ভর্তির পরই বিরাট সংখ্যক রোগীকে হাসপাতাল থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ার অংসখ্য ঘটনায়। নিজেদের তদন্তে দেখা গিয়েছে, বহু ক্ষেত্রে যে কারণে রোগীকে ফিরিয়ে দিয়েছে বা অন্যত্র পাঠানো হয়েছে, সেই চিকিৎসার পরিকাঠামো সংশ্লিষ্ট হাসপাতালেই ছিল। তারপরেও কখনও ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায়, কখনও দিনের পর দিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি খারাপ থাকায়, ওষুধপত্র না থাকায় চিকিৎসা না পেয়েই এখানে ওখানে দৌড়াতে হয়েছে রোগীদের। এক স্বাস্থ্য কর্তার কথায়,‘‘নবান্নের শীর্ষ মহলও মনে করে, জেলার রোগীদের জেলাতেই চিকিৎসা দিতে পারাটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। তাতে কলকাতার উপর চাপ কমে, আবার জেলার পরিকাঠামোও তৈরি হয়ে যায়।’’ সেই অঙ্কেই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের অন্যান্য সূচকের উন্নতির সঙ্গে ‘রেফার়-রোগ’ ঠেকাতে কড়া অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় বলে স্থাস্থ্য কর্তাদের দাবি।
স্বাস্থ্য ভবন জানাচ্ছে, রোগীর পরিস্থিতি সামান্য জটিল হলেই চিকিৎসকদের একাংশের মধ্যে হাত ধুয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। তা দেখেই সরকারি ডাক্তারদের হাসপাতালে হাজিরায় কড়াকড়ি করা হয়। লম্বা ছুটি নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যসচিবের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়। নার্সিং স্টাফ, স্বাস্থ্য কর্মীদের হাজিরাও খুঁটিয়ে দেখা শুরু হয়। বিভিন্ন প্রকল্পে কেনা যন্ত্রপাতি চালু আছে কি না, চালানোর লোক আছে কি না তারও নজরদারি শুরু হয়। সর্বোপরি চালু হয় ই-নজরদারি। যাতে কোনও হাসপাতাল রোগীকে চিকিৎসা না করে অন্যত্র পাঠালেই স্বাস্থ্য ভবনকে জানাতে হচ্ছে, কেন ‘রেফার’ করা হল। নির্দিষ্ট কারণ জানাতে না পারলেই সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে এ ব্যাপারে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। এক স্বাস্থ্য কর্তা জানাচ্ছেন, যদি ডাক্তার না থাকা রোগী ফেরানোর কারণ বলা হলে তখনই দেখা হচ্ছে ওই হাসপাতালের ডাক্তার গেলেন কোথায়? পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিকাঠামো না থাকার কথা বলা হলে দেখা হচ্ছে যন্ত্রপাচি সব কাজ করছে কি না। উপর থেকে লাগাতার চাপের ফলে নীচে ‘দায়িত্ব’ নিয়ে কাজ করার প্রবণতা বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন ওই কর্তা। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, আগে রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা শুরুর পর অন্যত্র পাঠানো হত। এখন হাসপাতালের দরজা থেকেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে তা হিসেবের খাতায় উঠছে না। কিছু কিছু হাসপাতাল আবার ‘রেফার’ করার বদলে ‘ডিসচার্জ’ লিখেও রোগী অন্যত্র পাঠাচ্ছে। তাতেও এড়ানো যাচ্ছে স্বাস্থ্য ভবনের হিসেবের খাতা।
যদিও দফতরের দাবি, ২০১৫-য় ২২টি জেলা হাসপাতালে ১১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৪০২ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে ৯৪ হাজার ২৭৩ জন রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন সেই সংখ্যা অর্ধেক হয়েছে।
তবে এর উল্টো প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। ডাক্তারদের উপর চাপ বৃদ্ধির ফলে সরকারি চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যেই মিছিল-মিটিং করেছেন। অত্যধিক জবাবদিহির চাপে ধর্মঘট করার হুমকিও দিয়ে বসেছিলেন তাঁদের একাংশ। এর পরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে ডেকে কথা বলেন সরকারি চিকিৎসকদের সঙ্গে। ‘সম্পদ’ ডাক্তারদের জন্য নরম তিনি। তবে ধাত এখনও কড়া রাখারই পক্ষে স্বাস্থ্য ভবন।