শঙ্করী দাসের নামে ভবন। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
কারও চোখে জল। কেউ হাসছেন হো হো করে। দশ ফুট বাই বারো ফুটের ঘরটার সামনে জটলা করে আছেন সকলে। যেন একটা জয় হয়েছে তাঁদের। অনেকদিন ধরে লড়াইয়ের পর একটা জয়। তাঁদের মধ্যে একজন ওই ঘরটার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, “এই ঘরটা শঙ্করীদি’র নামে হয়েছে। আমাদের শঙ্করীদিদি। যাঁকে আমরা ভালবাসতাম। তিনি আজ নেই। এই ঘরটায় তাঁর নাম থাকবে।”
দিনহাটার যৌনকর্মীদের পল্লির বাসিন্দা শঙ্করী দাস। যাঁর নামে ওই ঘর তৈরি করেছে দিনহাটা পুরসভা। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির লিয়াজো অফিসার মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় বলেন, “রাজ্যের কোথাও কোনও যৌনকর্মীর নামে ভবন তৈরি করেনি কোনও সরকারি সংস্থা। দিনহাটার প্রত্যন্ত জায়গায় পুরসভা তা করে দেখিয়েছে। ভবনটি আকারে ছোট হলেও তা আমাদের কাছে অনেক বড়। আমরা মনে করছি এই ভাবে একজন যৌনকর্মীকে স্বীকৃতি দেওয়া হল।”
আজ, মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই ঘর তুলে দেওয়া হবে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির হাতে। সেখানে একটি ক্লিনিক খোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন তাঁরা। যাতে সেখান থেকে চিকিৎসা পরিষেবা পান এই পল্লির বাসিন্দারা। ওই ঘরেই সকাল-বিকাল যৌনকর্মীদের পল্লির বাসিন্দাদের পড়াশোনা শেখানোর ব্যবস্থা করতে চান তাঁরা। দিনহাটা পুরসভার চেয়ারম্যান উদয়ন গুহ বলেন, “অনেকদিন ধরে একটা দাবি ছিল ওই এলাকার বাসিন্দাদের। তাই পূরণ করেছি। শঙ্করী দাস ওই এলাকার সবার শ্রদ্ধেয়। তাঁর নামেই ঘর করা হয়েছে। ওই ঘর দুর্বারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।”
বহু বছরের পুরনো দিনহাটার ওই যৌনর্মীদের পল্লি। কয়েকশো পরিবারের বাস সেখানে। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন শঙ্করী। আড়াই মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। শঙ্করীর কথা বলতে গিয়ে ওই এলাকার প্রায় সব মানুষের চোখে জল চলে আসে। তাঁরা জানান, যৌনকর্মীদের পল্লির মেয়েদের নানা অত্যাচারের মুখে পড়তে হয়। কখনও পুলিশ, কখনও স্থানীয় সমাজবিরোধীদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এমন কোনও ঘটনা ঘটলেই শঙ্করী গিয়ে দাঁড়াতেন সেখানে। শুধু এলাকার উন্নয়ন থেকে শুরু করে সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে সরব হয়েছেন তিনি। এই পল্লির মেয়েদের জন্য দুর্বারের পক্ষ থেকে যে সচেতনতামূলক প্রচার শুরু হয় তাতেও সবার আগে ছিলেন শঙ্করী। দুর্বারের পক্ষ থেকে পল্লির মেয়েদের নিয়ে ঊষা কোঅপারেটিভ সোসাইটি তৈরি করা হয়। সেখানেও মেয়েদের কাছ থেকে টাকা তুলে জমা করতেন তিনি। সেই শঙ্করীর মৃত্যুর পর গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। বড় বড় ফেস্টুন তৈরি করে গোটা শহরে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। হয় শঙ্করীর স্মরণসভাও। তাঁর নামেই ওই ঘর তৈরি করার দাবি করা হয়।
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক বছর আগেই একটি ভবনের দাবি করে পুরসভার দ্বারস্থ হন এই পল্লির মেয়েরা। দুই লক্ষ টাকা খরচ করে পুরসভার একটি জায়গাতেই ওই ঘর তৈরির কাজ শুরু করা হয়। সোনাগাছি থেকে দুর্বারের বড় একটি টিম এখানে চলে এসেছে। ‘কোমল গান্ধার’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে তাঁদের। যেখানে এই পল্লির ছেলেমেয়েরাই অংশ নেয়। আট জনের একটি দল এখানে এসেছে। মঙ্গলবার নানা অনুষ্ঠান করবেন তাঁরা। দুর্বারের অন্যতম উপদেষ্টা স্মরজিৎ জানা বলেন, “কলকাতার মতো শহরে আজও কত অসম্মানের মুখে পড়তে হয় যৌনকর্মীদের। সেখানেও দিনহাটার মতো প্রত্যন্ত শহরের এই স্বীকৃতি তাঁদের মনোবলকে চাঙ্গা করবে।”