প্রধান শিক্ষকের উদ্যোগে স্কুলে বসেছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন

বছর চোদ্দোর মেয়েটার মৃত্যুতে শ্মশানে সবাই যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, এক কোণে দাঁড়িয়ে তিনি শপথ নিচ্ছিলেন। শপথ নিচ্ছিলেন যে, অন্তত তাঁর স্কুলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হতে দেবেন না।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৪
Share:

ছাত্রীদের সঙ্গে তাদের প্রিয় হেড মাস্টারমশাই। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

বছর চোদ্দোর মেয়েটার মৃত্যুতে শ্মশানে সবাই যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, এক কোণে দাঁড়িয়ে তিনি শপথ নিচ্ছিলেন। শপথ নিচ্ছিলেন যে, অন্তত তাঁর স্কুলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হতে দেবেন না।

Advertisement

শৌচাগার ছিল না সুন্দরবনের কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলে। স্কুল থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা ছাউনি দেওয়া জায়গাকেই ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীরাও শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করত। ঋতুকালীন সময়ে বহু ছাত্রীই স্কুলে আসত না। এলেও অনেকেই নানা অসুখ-বিসুখে পড়ত। ক্লাস এইটের অনন্যা পুরকায়েত ছিল তাদেরই একজন। হঠাৎই এক দিন স্কুলে আসা বন্ধ হল তার। প্রথমে কেউ বিষয়টাকে গুরুত্ব দেননি। পরে জানা গেল, যোনিদ্বারে প্রবল সংক্রমণ হয়েছে অনন্যার। টানা কয়েক দিন ধরে চলছে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। দিন কয়েকের মধ্যেই মারা যায় সে।

ঘটনাটা ২০০৮ সালের। স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি তখনই ঠিক করেছিলেন, যে করে হোক এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাবেনই।

Advertisement

কিন্তু টাকা আসবে কী ভাবে? বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলেন। ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ বা সিএসআর প্রকল্পে বিভিন্ন সংস্থা দেদার টাকা ব্যয় করে। তা হলে স্কুলের মেয়েদের স্বাস্থ্য প্রকল্পে টাকা আসবে না কেন? লাগাতার চেষ্টাচরিত্র চালিয়ে একাধিক সংস্থাকে রাজি করিয়ে টাকা আনানোর ব্যবস্থা করলেন। এখন স্কুলে ছাত্র ও ছাত্রীদের আলাদা শৌচাগার। ঝকঝকে-তকতকে।

কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়। গ্রামের দিকে সাধারণ ভাবে ঋতুস্রাবের সময়ে মেয়েরা কাপড় ব্যবহার করেন। বহু সময়েই সেই কাপড় পরিষ্কার থাকে না। কিংবা একবার ব্যবহারের পরে ফের তা কেচে ব্যবহার করেন অনেকে। ঠিক মতো পরিষ্কার না হওয়ায় তা থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর নজির ভূরি ভূরি। এই সমস্যার সমাধান হবে কী ভাবে? চন্দনবাবু ফের দ্বারস্থ হলেন বিভিন্ন সংস্থার। এমনই একটি সংস্থার উদ্যোগে মথুরাপুরের কাছে ওই স্কুলে এ বার বসেছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন। এই অগস্টে অনন্যার জন্মদিনেই সেই মেশিনের উদ্বোধন হল। চন্দনবাবুর কথায়, ‘‘এ আমাদের সামাজিক প্রায়শ্চিত্ত।’’

বড়সড় শহরেও যেখানে মেয়েদের ‘পিরিয়ড’ নিয়ে ট্যাবুর শেষ নেই, যেখানে কালো প্যাকেটে বা খবরের কাগজে না-মুড়ে দোকানে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রিই হয় না, সেখানে গ্রামের একটি কো-এডুকেশন স্কুলে কোনও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি? একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রকে প্রশ্নটা করতেই সরাসরি চোখের দিকে তাকায় সে। উত্তর দেয়, ‘‘স্যার আমাদের সবটা বুঝিয়েছেন। এখন আমরাও বাড়িতে গিয়ে মাকে-দিদিকে বলি, তোমরা কাপড় ব্যবহার কোরো না।’’ চন্দনবাবুর কথায়, ‘‘এ নিয়ে প্রায় সব জায়গাতেই লুকোচুরির শেষ নেই। পুরো বিষয়টার সঙ্গে কেমন যেন যৌনতার গন্ধ লেগে রয়েছে। আমি শিক্ষক হয়ে যদি এটা কাটানোর চেষ্টা না করি, কে করবে?’’

পরিবর্তন এসেছে স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যেও। আর্ট টিচার শঙ্কর ময়রা বলছিলেন, ‘‘আমরাও আগে যা নিয়ে উচ্চবাচ্য করতাম না, এখন তা নিয়ে খোলামেলা কথা বলি।’’ জাতীয় সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, এ দেশে ৬৮ শতাংশ মহিলা এখনও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। অধিকাংশ গ্রামের স্কুলে তো বটেই, শহরের স্কুলেও শৌচাগারের হাল খুবই খারাপ। অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধে ভরা শৌচাগার এড়িয়ে যাওয়ার জন্য একেবারে ছোট্ট বয়স থেকেই মেয়েরা জল কম খাওয়া শুরু করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে নানান জটিলতা। তৈরি হয় কিডনির সমস্যাও। ‘‘সরকার বলছে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও!’ বেটি বাঁচবে কী করে যদি এই বয়সেই তাদের সংক্রমণ হয়?’’ সিসিটিভি-তে গোটা স্কুলের ওপরে নজর রাখতে রাখতে বলছিলেন চন্দনবাবু।

বিশাল মাঠ, প্রচুর গাছগাছালি, পুকুর, স্কুলের পাশে ছাত্র ও ছাত্রীদের পৃথক হস্টেল। সব মিলিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রপুরে চন্দনবাবুর ভরা সংসার। যাদবপুরের একটি স্কুলে চাকরি করতেন। গ্রামে কাজ করার ইচ্ছা নিয়ে যেচেই চলে এসেছিলেন এখানে। কলকাতার বাড়ি ফেলে এখন এটাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। স্কুল চালানোর সুবাদে একাধিক ছোট-বড় স্বীকৃতি জুটেছে। ২০১১ সালে সচিন তেন্ডুলকরের ‘সাপোর্ট মাই স্কুল’ প্রকল্পে স্কুলের উন্নয়নের জন্য আর্থিক সাহায্যও পেয়েছিলেন। নিজের একমাত্র ছেলেও এই স্কুলে পড়ে। কর্মীরা জানালেন, সকাল সাড়ে আটটায় স্কুলে ঢোকেন স্যার। বেরোতে বেরোতে রাত ন’টা।

স্ত্রীরোগ চিকিৎসকদের মতে, চন্দনবাবু যে ভাবে মেয়েদের স্বাস্থ্যের হাল বদলের চেষ্টা করছেন, তা আরও অনেক স্কুলকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। একই কথা বলছে মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার সিএসআর-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারাও জানিয়েছেন, এই ধরনের প্রস্তাবে তাঁরা আগ্রহী। এক বহুজাতিকের কর্তার কথায়, ‘‘এই দিশাটা আমাদের জন্যও জরুরি ছিল। এমন জোরালো সামাজিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে পারলে আমাদের খুবই ভাল লাগবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement