পুলিশ খুনেও মামলা তোলার আর্জি সরকারের

রাজনৈতিক সংঘর্ষ রুখতে গিয়ে বোমায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি। দুর্গাপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ৫৫ দিন যুঝে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। দুবরাজপুর থানার সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর অমিত চক্রবর্তীর খুনে অভিযুক্তদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই মামলা প্রত্যাহার করে নিতে চায় রাজ্য সরকার!

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৭
Share:

অমিত চক্রবর্তী

রাজনৈতিক সংঘর্ষ রুখতে গিয়ে বোমায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি। দুর্গাপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ৫৫ দিন যুঝে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। দুবরাজপুর থানার সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর অমিত চক্রবর্তীর খুনে অভিযুক্তদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই মামলা প্রত্যাহার করে নিতে চায় রাজ্য সরকার!

Advertisement

ওই হত্যাকাণ্ডে পুলিশেরই জমা দেওয়া চার্জশিটে নাম থাকা মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-সহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে মঙ্গলবার সিউড়ি আদালতে আবেদন জমা করেছেন বীরভূমের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)। এই ঘটনা জানাজানি হতেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে জেলা পুলিশের নিচুতলার বড় অংশে। বিরোধীরা আবার কটাক্ষ করছেন, বীরভূম পুলিশের ‘কঠিন সময়’ এখনও চলছে।

যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা তোলার আর্জি জানানো হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই শাসকদলের নেতা-কর্মী-সমর্থক। কয়েক জন সিপিএম নেতা-কর্মীও অবশ্য আছেন। কিন্তু, মামলা থেকে কারও নাম বাদ পড়ুক, তা চাইছেন না এই ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত দুবরাজপুরের সিপিএম নেতা সৈয়দ মকতুল হোসেনই! বরং বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চান।

Advertisement

সরকারি আইনজীবীই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা তোলার সওয়াল করেছেন শুনে স্তম্ভিত নিহতের পরিবারও। অমিত ছিলেন চুঁচুড়ার বাসিন্দা। রথতলা এলাকায় তাঁর বৃদ্ধ পিসেমশাই লক্ষ্মীনারায়ণ মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ও (অমিত) তো সরকারেরই কর্মী ছিল! সরকারি কাজ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিলে কী আর করব! এমন করে হয়তো আরও অনেকে মরবে, কিন্তু দুষ্কৃতীরা রেহাই পেয়ে যাবে।’’

২০১৪-র ৩ জুন দুবরাজপুরের যশপুর পঞ্চায়েতের আউলিয়া-গোপালপুরে তৃণমূল-সিপিএমের সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারা যান বছর পঁয়ত্রিশের অমিত। পুলিশ দু’দলের ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। অমিতের মৃত্যুর পরে রুজু হয় খুনের মামলা। অভিযুক্তদের তালিকায় নাম ছিল দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তথা তৃণমূল নেতা আলিম শেখ-সহ এলাকার প্রায় ৩০ জন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের। জোনাল নেতা সৈয়দ মকতুল হোসেন-সহ কিছু সিপিএম কর্মীরও নাম ছিল তালিকায়। কিন্তু, পুলিশ মাত্র ১৬ জনকে ধরতে পেরেছিল। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ উপেক্ষা করে বাকিদের কেন ধরা যাচ্ছে না, তা নিয়ে ক্ষোভ ছিল পুলিশ মহলেও। পরে মকতুল হোসেন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওই বছর অগস্টে দুবরাজপুর আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। আলিম শেখ-সহ শাসকদলের অধিকাংশ অভিযুক্ত কিন্তু আজও অধরা।

ঘটনার দু’বছরের মাথায় হঠাৎ সিউড়ি আদালতে আলিম-সহ ৩৬ জন অভিযুক্তের নাম ‌(তৃণমূলের লোকজনের সংখ্যাই বেশি) বাদ দেওয়ার আবেদন জানান জেলার পিপি। ১৯ জানুয়ারি ওই আবেদনের শুনানি হবে বলে জানান অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী তপন সাহানা।

কেন এই আর্জি?

রণজিৎবাবুর দাবি, এক জনের ছোড়া বোমাই আহত হয়ে পরে মৃত্যু হয় অমিতের। এক জন বোমা ছুড়লেও পুলিশ ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। ‘‘এলাকা থেকে পাওয়া আবেদন দেখে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে এবং নিজে তদন্ত করে দেখেছি, ওই অভিযুক্তদের অধিকাংশই নিরপরাধ। তাই এই আবেদন। সিপিএম-তৃণমূল বিভেদ করা হয়নি,’’— বলে দিচ্ছেন পিপি।

সিপিএমের অবশ্য বক্তব্য, ৩৬ জনের তালিকায় তাদের দু-চার জন তাদের কর্মীর নাম রেখে সরকার ‘নিরপেক্ষ’ সাজার বৃথা চেষ্টা করছে। দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘সরকারি আইনজীবীর এই সওয়ালে আবার স্পষ্ট হয়ে গেল, এটা সত্যিই সমাজবিরোধীদের সরকার!’’ বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘আইন আইনের পথে চলবে।’’

এমন আবেদনে কিন্তু অবাক রাজ্য পুলিশের অনেক শীর্ষ কর্তাও। এক জনের কথায়, ‘‘৩৬ জনের বিরুদ্ধেই যদি মামলা তুলে নেওয়া হয়, তা হলে পুলিশ মামলা চালাবে কাদের বিরুদ্ধে! এই ঘটনায় নিচুতলার কর্মীদের মনোবল তো ভাঙতেই পারে।’’

হতাশ অমিতের বোন অমিতাও। ‘‘কে আর অপরাধ কমানোর
ঠেকা নিচ্ছে! সত্য প্রকাশ পাচ্ছে কিনা, তাতে কার কী যায় আসে! কারও বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমি শুধু জানি, দাদাভাইকে আর ফিরে পাব না!’’— চুঁচুড়ার জোড়াঘাটের বাড়িতে কান্নায় গলা বুজে আসে তাঁর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement