কেশরীনাথ ত্রিপাঠী ও নির্মল মাজি
দৃষ্টি আকর্ষণ করে খোদ রাজ্যপালের চিঠি এসেছে এক মাস হতে চলল! এখনও আড় ভাঙল না স্বাস্থ্যভবনের!
চিঠির উপলক্ষ— এসএসকেএমের কুকুর-কাণ্ডে নির্মল মাজির ভূমিকা ও সেই প্রেক্ষিতে তাঁর ডানা ছাঁটার দাবি।
কুকুর-কাণ্ডের জেরে মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক-নেতা তথা তৃণমূল বিধায়ক নির্মলবাবু ইতিমধ্যে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতির পদ-সহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরানোর আর্জি জানিয়ে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছিল রোগীস্বার্থে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তার ভিত্তিতে রাজ্যপালের দফতর স্বাস্থ্য-সচিবকে চিঠি পাঠায়। তাতে বলা হয় বিষয়টি খতিয়ে দেখে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু মাস পেরোতে চললেও ব্যবস্থা তো দূরস্থান, রাজভবনের বার্তা সম্পর্কে উচ্চবাচ্যও করছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা! আপাতত তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে সূত্রের খবর।
কুকুর-কাণ্ডের কথা সবিস্তার জানিয়ে গত ১৭ জুন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীকে চিঠি (ই মেল) দেওয়া হয়েছিল। ২৩ জুন রাজ্যপালের দফতর থেকে সেটি স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে’কে পাঠিয়ে বিষয়টির দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। সংগঠনের কর্তাদের অভিযোগ: রাজভবনের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাওয়া হলে স্বাস্থ্যকর্তারা জবাব দিচ্ছেন না। রাজ্যপালের চিঠিকেও কোন যুক্তিতে অবজ্ঞা করা যায়, এ বার খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে তার ব্যাখ্যা চাইছে সংগঠনটি।
স্বাস্থ্য ভবনকে পাঠানো রাজভবনের সেই চিঠি
অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গের সবেধন নীলমণি সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমে একটি কুকুরের ডায়ালিসিস করাতে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি নির্মলবাবু, যিনি কিনা চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতিও বটে। নির্মলবাবুর ‘ইচ্ছে’ পূরণ করতে নেফ্রোলজি’র ডাক্তারবাবুদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যিনি, তিনিও মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত— এসএসকেএমের নেফ্রোলজি’র বিভাগীয় প্রধান রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। শেষমেশ অবশ্য এক চিকিৎসকের আপত্তিতে মানুষের হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিসের মতো বেনজির ঘটনা ঘটতে পারেনি। তবে উদ্যোগটির খবর ফাঁস হয়ে গিয়ে রাজ্য-রাজনীতিতে তোলপাড় পড়ে যায়। এসএসকেএমের তদানীন্তন অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রকে তড়িঘড়ি বদলি করা হয়। যদিও রাজেনবাবু বা নির্মলবাবুর গায়ে আঁচটুকুও লাগেনি। চিকিৎসক মহলের বড় অংশের পর্যবেক্ষণ, ‘সরকারের’ ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে শাসকদলের সমর্থনপুষ্ট কিছু চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে কী রকম যথেচ্ছাচার চালাচ্ছেন, কুকুর-কাণ্ডই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
পাশাপাশি বিভিন্ন মহল মনে করছে, এ ক্ষেত্রে নির্মলবাবু নিজে ডাক্তার হয়েও ‘মে়ডিক্যাল এথিক্স’-এর ধার ধারেননি। ফলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় আসীন থাকার অধিকার তাঁর আর আছে কিনা, সে প্রশ্ন জোরদার হয়। নয়াদিল্লির জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল (এমসিআই)-ও নির্মলবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ জানায়। ঘটনাটিকে ‘অকল্পনীয় ও হাস্যকর’ হিসেবে বর্ণনা করে কাউন্সিলের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ও গ্রিভান্স সেলের চেয়ারম্যান অজয়কুমার তখন বলেছিলেন, এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই পারেন যথোচিত ব্যবস্থা নিতে।
কোনও ব্যবস্থা অবশ্য হয়নি। কিন্তু এখন স্বয়ং রাজ্যপালের অফিস সক্রিয় হতে বলার পরেও কর্তারা চুপ কেন?
স্বাস্থ্য-সচিব মলয়বাবু মুখ খোলেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি পূর্ণমন্ত্রী নই। কিছু বলতে পারব না।’’ কিন্তু চিঠিটা তো স্বাস্থ্যভবনেই পাঠানো হয়েছে! তা-ও কিছু হবে না? মন্ত্রীর জবাব, ‘‘সে খবর নেওয়া তো আপনাদের কাজ!’’
মন্ত্রী প্রসঙ্গ এড়ালেও এক শীর্ষ স্বাস্থ্যকর্তা নিজেদের বিড়ম্বনা ও অসহায়তা গোপন করেননি। ‘‘রাজভবনের চিঠি পেয়ে আমরা খুব অস্বস্তিতে রয়েছি। বুঝতে পারছি, ঠিক হচ্ছে না। অথচ কিছু করার নেই। আমাদের হাত-পা বাঁধা।’’— আক্ষেপ করেছেন তিনি। এ-ও বলেছেন, ‘‘চিঠিটা নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। যদি কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার থাকে, উনিই নেবেন।’’
প্রতিকার না-পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটিও। ‘পিপল ফল বেটার ট্রিটমেন্ট’ নামে ওই সংগঠনের সভাপতি কুণাল সাহা তাতে লিখেছেন, ‘সাধারণ রোগীদের স্বার্থেই নির্মল মাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করে উনি বড়সড় ক্ষতি করে চলেছেন। দায়িত্বপূর্ণ পদগুলি থেকে ওঁকে অবিলম্বে না-সরালে আখেরে রাজ্যেরই লোকসান।’
বস্তুত স্বাস্থ্যে ‘স্বেচ্ছাচারের’ নানা ছবি পরের পর সামনে আসায় রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের একাধিক সদস্যও তিতিবিরক্ত। তাঁদের কয়েক জনও ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন। তেমন এক জন বলেন, ‘‘রাজনৈতিক আনুগত্য এক জিনিস। কিন্তু এ ভাবে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে যা ইচ্ছে তা-ই করে গেলে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। সেটাই হচ্ছে।’’
নির্মলবাবুর কী প্রতিক্রিয়া?
রবিবার তাঁর নম্বরে ফোন করা হলে যিনি ধরেন, প্রথমে তিনি নিজেকে নির্মল মাজি হিসেবেই পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু পুরো বিষয়টি শোনার পরে তিনি বলেন, ‘‘আমি গাড়ির ড্রাইভার। নির্মল মাজি এখন ব্যস্ত আছেন।’’
বলেই ফোন কেটে দেন।