খড়্গপুরের কৌশল্যায় চলছে সাইকেল সারানোর কাজ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
জঙ্গলমহল কাপের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে। বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দিলেন, বাংলায় ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পে ৪০ লক্ষ ছেলেমেয়েকে সাইকেল দিচ্ছে তাঁর সরকার। তৃণমূল নেত্রী বললেন, ‘‘সাইকেল কেন দিচ্ছি জানেন? এই কৃতিত্বটা জঙ্গলমহলের। আমি এক বার বেলপাহাড়ি দিয়ে যাচ্ছিলাম। একটা ছেলে এসে বলল, দিদি, আমরা সাইকেল পাব না? তখন মনে হল, সত্যি তো! শুধু মেয়েরা পাবে, ছেলেরা পাবে না?’’
বাম জমানার শেষ দিকে প্রকল্পটা শুরু হয়েছিল শুধু মেয়েদের জন্যই। গরিব পরিবারের মেয়েদের স্কুলমুখী করতে দেওয়া হচ্ছিল সাইকেল। ক্ষমতায় এসে মমতা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির সমস্ত স্কুলপড়ুয়াকেই এই প্রকল্পের আওতায় এনেছেন। এ দিনও মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, দিল্লি সব টাকা কেটে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি সাইকেল দেওয়া বন্ধ করেননি।
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী যখন এই কথা বলছেন, তখন কারও কারও মনে পড়েছে ঠিক দু’দিন আগেকার দৃশ্যগুলো। অকুস্থল মেদিনীপুরেরই লাগোয়া রেলশহর খড়্গপুর!
গত রবিবারের দুপুর। খড়্গপুর শহরের কৌশল্যা মোড়ের সাইকেল সারাইয়ের দোকানে তখন বেশ ভিড়। পাঁচ-পাঁচটা নতুন সাইকেল মেরামত করতে ব্যস্ত মিস্ত্রিরা। প্রতিটির রং নীল-সাদা। সামনের বাস্কেটে লেবেল সাঁটা— ‘সবুজ সাথী।’ এই সব সাইকেলের কোনওটার ব্রেক ধরে না, কোনওটার বল-বেয়ারিং খারাপ, কোনওটার চাকায় হাওয়া নেই। শনিবারই হিজলি হাইস্কুল থেকে বিলি করা হয়েছিল এই সাইকেলগুলো। মূলত খড়্গপুরের সিলভার জুবিলি হাইস্কুলের পড়ুয়ারাই সাইকেল পেয়েছিল ওই দিন। কিন্তু বাড়ি ফিরেই ওই পড়ুয়াদের একটা বড় অংশকে নতুন সাইকেল নিয়ে ছুটতে হয়েছে মেরামতির দোকানে!
রবিবার সকাল থেকেই খড়্গপুরের কৌশল্যা, পুরাতন বাজার, গাইকাটা এলাকার একাধিক দোকানে ছিল ‘সরকারি’ সাইকেলের ভিড়। প্রায় সব দোকানের মালিকেরাই জানিয়েছেন, সাইকেলগুলো মেরামত করতে গড়ে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করে পড়বে। সিলভার জুবিলি হাইস্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সন্দীপ মণ্ডল কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে মিলে শনিবার পিক-আপ ভ্যান ভাড়া করে অকেজো সাইকেল বাড়িতে এনেছিল। তাতে দু’শো টাকা লেগেছে। আর সাইকেল সারাতে হয়েছে তিনশো টাকা দিয়ে। এর আগে মেদিনীপুর ও ঘাটালেও ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছিল পড়ুয়ারা। একই ছবি বীরভূমে। সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতালের সামনের সাইকেল দোকানের
মালিক সম্প্রতি জানান, দিনে গড়ে ১০-১৫টি সরকারি সাইকেল সারাতে হচ্ছে তাঁদের।
এই পরিস্থিতিতে সাইকেল-প্রকল্পে বড়সড় দুর্নীতি রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস। প্রদেশ নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘বিনা টেন্ডারে সাইকেল দেওয়ার নামে বহু টাকা লুঠ হচ্ছে। এই প্রকল্পে কেন্দ্রের কত টাকা, রাজ্যের কত টাকা, কত জন সাইকেল পাচ্ছে, যাবতীয় তথ্য দিয়ে রাজ্য সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক।’’ তিনি আরও জানিয়েছেন, তৃণমূল সরকার দাবি মানবে বলে মনে হয় না। তাই তাঁরা জনস্বার্থ মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাজ্য সরকারের তফসিলি জাতি-উপজাতি নিগম সূত্রে অবশ্য জানানো হয়েছে, নিয়ম মাফিক ই-টেন্ডার করেই সাইকেলগুলি কেনা হয়েছে। সাইকেল-পিছু প্রায় আড়াই হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এই প্রকল্পে কেন্দ্রের কোনও টাকা নেই। গোটাটাই রাজ্যের বরাদ্দ অর্থে। ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পে রাজ্যে প্রায় ৪০ লক্ষ সাইকেল বিলি হওয়ার কথা। এর জন্য খরচ হবে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা।
কাজেই এত অর্থ ব্যয় করে অকেজো সাইকেল দেওয়ার মানে কী, সেই প্রশ্ন তুলছেন সকলেই। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, ‘‘হাতে গোনা কিছু সাইকেল ঠিক অবস্থায় আছে। বাকি সাইকেল শুধু চড়বার মতো অবস্থায় আনতেও মানুষকে দোকানে লাইন দিতে হচ্ছে। সরকার যা করছে, সবই লোক দেখানো।’’
সাইকেল নিয়ে এত ঝক্কি কেন?
প্রশাসনের একটি সূত্রের দাবি, মজুত রাখার মতো জায়গা না পেয়ে হাজার হাজার সাইকেল ফেলে রাখতে হচ্ছে ব্লক অফিস চত্বর, কিসান মান্ডি কিংবা স্কুলের মাঠে। রোদে-জলে পড়ে থেকে সেগুলির কলকব্জা ঢিলে হচ্ছে। ফলে, বিলি করার সময়ে এত বিপুল সংখ্যক সাইকেল সারিয়ে তোলা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমাদের কাছে এখনও এমন কোনও খবর নেই।’’ খড়্গপুর শহরের তৃণমূলের পুরপ্রধান প্রদীপ
সরকারও শিক্ষামন্ত্রীর সুরে বলেছেন, “সাইকেল নিয়ে কোনও অভিযোগ জানা নেই।” শিক্ষামন্ত্রীর অবশ্য আশ্বাস, সাইকেল নিয়ে অভিযোগ এলে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দিয়ে দেখবে প্রশাসন। তাঁর কথায়, ‘‘গুণগত মান যাচাইয়ের পরেও সাইকেল হোক বা নতুন গাড়ি, রাস্তায় খারাপ হয়ে যেতেই পারে। অপপ্রচার চালাতে গিয়ে বিরোধীরা সরকারের ভাল উদ্যোগটা দেখছেন না।’’