মায়ের সঙ্গে মাদুর বুনছেন সাগরিকা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
চটে গিয়েছে পদকের রং। প্রতিবন্ধকতা জয় করে যে সোনার মেয়ে স্বপ্ন বুনতেন, তিনি এখন মাদুর বোনেন। মাঝে কেটেছে ১১ বছর।
পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের শ্রীরামপুরের সাগরিকা হাজরা শৈশবেই কথা বলা আর শোনার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নার রামকৃষ্ণায়ণ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবন্ধী স্কুলে। আর সময় পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে পুকুরের এপা়ড়-ওপাড় করা। সাঁতার তো অনেকেই কাটে। কিন্তু এ মেয়ের মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে বুঝেছিলেন শিক্ষকেরা। স্কুলের সুইমিং পুলেই শুরু হয়েছিল সাঁতারের খুঁটিনাটি শেখা। কলকাতার প্রশিক্ষকেরা নিয়মিত অনুশীলন করাতেন সাগরিকাকে। পরের পর্বটা লড়াই আর উত্তরণের।
২০০৭ সাল। চিনের সাংহাইতে বিশেষ অলিম্পিক্সের আসর। সাঁতারে দু’টি ইভেন্টে প্রতিযোগী সাগরিকা। কেউ বলেনি, ‘ফাইট সাগরিকা ফাইট।’। বললেও শোনার ক্ষমতা নেই। তবে এ টুকু বোঝার ক্ষমতা আছে যে মাদুরের ফেরিওয়ালা বাবা কত কষ্ট করে সংসার চালান। তাঁর জন্য কত কথা শুনতে হয়েছে মাকে। এসব মনে রেখেই সাঁতরেছিল সাগরিকা। একটি ইভেন্টে এসেছিল সোনা, আরেকটিতে রুপো।
এরপর এক লহমায় জীবন-বদল। পাড়ার মোরাম রাস্তায় গাড়ির ভিড়। নেতাদের প্রতিশ্রুতি। দিল্লিতে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলের হাত থেকে সংবর্ধনা। হাতে চাপা পদকে পড়েছিল চোখের নোনতা জল। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল দু’চোখ। স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ তো চাকরি!
একযুগ হয়নি এখনও। তবে গোত্তা খেয়ে খেয়ে পড়েছে বছর চৌত্রিশের সোনার মেয়ের স্বপ্ন-উড়ান। বাড়িতে কেউ গেলে হাত-পা নে়ড়ে সে কথা বুঝিয়েও দেয় সে। ছলছল চোখে মা দুর্গাদেবী বলছিলেন, “দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের অবর্তমানে এই মেয়েটার ভবিষ্যৎ কী? সেই সময় কত প্রতিশ্রুতি। আজ কেউ আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না।” সাঁতারও আর কাটেন না সাগরিকা। মায়ের সঙ্গে বাড়ির কাজ সামলে মাদুর বোনেন তিনি।
কোনির ছিলেন ক্ষিদ দা। সাগরিকার আছেন তাঁর শিক্ষক অরিজিৎ দাস অধিকারী। তিনি বললেন, “এ ভাবে একটা প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে, কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। সাগরিকার অবস্থা জানলে নতুন প্রজন্ম খেলাধুলোয় আগ্রহ হারাবে।” সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা আইএসআই-এর বিজ্ঞানী সমরেন্দ্র বারিক সাগরিকার কথা জেনেছেন। তিনি বলেন, “একজন অলিম্পিকজয়ী মাসে ৭৫০টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন, মাদুর বুনছেন এর থেকে দুর্ভাগ্যের কী হতে পারে! ওঁর জন্য যতদূর যেতে হয় যাব।” ২০০৭ সালে বাড়িতে এসেছিলেন মানস ভুঁইয়া। তখন তিনি বিধায়ক। এখন সাংসদ। মানসের যুক্তি, “আমি বহু চেষ্টা করেছিলাম। তখন বাম সরকার। হয়তো চাকরি দিতে পারিনি। তবে আবারও চেষ্টা করব।’’
যত্নের অভাবে পদকের রং চটেছে। তা নিয়ে আক্ষেপও নেই। কিন্তু ৭৫০ টাকায় তো চলে না! জীবন-সমুদ্রে তাই সাঁতরে চলেছেন সাগরিকা।