লড়াকু: মধুপুরের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে সীমা অধিকারী। —নিজস্ব চিত্র।
লেখাপড়া করবে না বলে বাড়ি থেকে পালানোর খবর শোনা যায় মাঝেমধ্যেই। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছেন বা পালাতে বাধ্য হয়েছেন মথুরাপুরের তরুণী সীমা অধিকারী। স্কুল তাঁকে ভর্তি নিয়েছে। ঠাঁই হয়েছে স্কুলের ছাত্রী-নিবাসে।
কেন? ‘‘আমি পড়াশোনা করে বাঁচতে চাই, স্বনির্ভর হতে চাই,’’ বলছেন সীমা। বিয়ের কয়েক মাস পরে বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছেন তিনি। স্বনির্ভর হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর-নালোয়ার ওই তরুণীর আর্ত আবেদন, ‘‘সরকার আমাকে সাহায্য করুক।’’
‘ভাল’ পাত্র পেয়ে হাতছাড়া করতে চায়নি পরিবার। গত নভেম্বরে তারা একমাত্র মেয়ে সীমার বিয়ে দিয়ে দেয় রায়দিঘি থানা এলাকার কালিকাপুর বৈরাগীচকের বাসিন্দা নারায়ণ আধিকারীর সঙ্গে। দেরিতে স্কুলে ভর্তি হয়ে সীমা তখন পড়তেন নবম শ্রেণিতে। তিনি জানান, পণ হিসেবে কয়েক হাজার নগদ টাকা, সোনার গয়না, খাট ও আলমারি দাবি করেছিল পাত্র পক্ষ। সীমার বাবা গৌর অধিকারী সামান্য কাঠমিস্ত্রি। তাই নগদ টাকা দিতে পারেননি।
সীমার মা আরতিদেবী বললেন, ‘‘আত্মীয়স্বজনের থেকে চেয়েচিন্তে সবই দেওয়া হয়েছিল। শুধু নগদ টাকা দেওয়া যায়নি। তার জন্য মেয়েকে ওরা মারধর করত।’’ সীমা জানান, তাঁর স্বামী মাঝেমধ্যেই ঘর থেকে বার করে দিয়ে বাবার কাছ থেকে বাকি টাকা নিয়ে আসতে বলতেন। ‘‘কত রাত ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কেঁদেছি। বাবার পক্ষে বাকি টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। দিনের পর দিন নিজের আর বাবার অপমান আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই গত মে মাসে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি,’’ বললেন সীমা।
পণ, মারধরের কথা সংশ্লিষ্ট গিলেরছাট গ্রাম পঞ্চায়েতে জানানো হয়েছিল। পঞ্চায়েতের সদস্য রহিম আলি গাজি জানান, দু’পক্ষকে নিয়ে সভা করে মিটমাটের চেষ্টা হয়েছিল। ‘‘আমরা চাইতাম, ওরা সংসার করুক। মেয়েটিকে সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিই। ওঁর মত জানার জন্য সভা এক মাস মুলতুবি রাখা হয়। তার পরে ২২ দিন কেটে গিয়েছে। মেয়ের বাড়ির তরফে আমাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়নি,’’ বলেন রহিম আলি। রবিবার সীমার স্বামী নারায়ণ অধিকারীকে ফোনে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা জানালে তিনি সুর চড়িয়ে বলেন, ‘‘যে অভিযোগ করছে, তাকে এবং আপনার দলবল নিয়ে আমার সামনে এসে কথা বলুন।’’ পরে সুর নামিয়ে বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলব না।’’
স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরেই আবার স্কুলে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন সীমা। তাঁর মা জানান, দুই ছেলেকে আর স্বামীকে নিয়ে চার জনের সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। মেয়ের পড়ার খরচ চালানো মুশকিল।
মেয়ে কিন্তু নাছোড়। শ্বশুরবাড়ি থেকে পালানোর প্রায় তিন মাস পরে মথুরাপুরের কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন সীমা। প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি বলেন, ‘‘সীমাকে বলা হয়েছে, হস্টেলে থেকে ও পড়াশোনা করতে পারে। পড়াশোনার কোনও খরচ দিতে হবে না।’’
সীমার প্রতিজ্ঞা, ‘‘আমি স্বনির্ভর হয়ে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে সকলকে দেখাতে চাই, শুধু বিয়ে করার জন্য মেয়েরা জন্মায়নি।’’ আর জেলা প্রশাসন থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, সম্ভাব্য সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধাই পাবেন সীমা।