বহরমপুরে রেস্তোরাঁয় ফিরে কাজে ব্যস্ত সুমন্ত লেট। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
কত কী-ই তো হয়ে যেতে পারত!
সেই যে বুধবার বাড়ি ছেড়েছিল, আর ফেরেনি। বড় আদরের একমাত্র মেয়ের চিন্তায় সাররাত বাবা-মায়ের মন কি কম কু-ডাক ডেকেছিল! দিনকাল ভাল নয়। কোথায় গেল, কার খপ্পরে পড়ল, সে-সব চিন্তা করে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু, কিছুই হয়নি। হয়নি স্রেফ সুমন্তর জন্য। বাড়িতে বকুনি খেয়ে তাঁর কাছে পালিয়ে আসা সেই বছর বারোর মেয়েটিকে যে পুলিশের সহযোগিতায় নিরাপদে বাবা-মায়ের পৌঁছে দিয়েছেন সুমন্তই।
ন’মাস আগে দার্জিলিংয়ের হোটেলে পরিচয়। তার পরে দু’জনের বন্ধুত্ব। বরাহনগরের মেয়ের সঙ্গে রামপুরহাটের বড়জোল গ্রামের সুমন্ত লেটের। তখন দার্জিলিঙের হোটেলে কাজ করতেন বছর চব্বিশের ওই যুবক। এখন তিনি বহরমপুরের একটি রেস্তোরাঁর ম্যানেজার। কিন্তু, ফোনে মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সুমন্ত ওরফে সুমনের। সেই সুবাদেই মেয়েটি পালিয়ে এসেছিল তাঁর কাছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীটিকে পড়াশোনা নিয়ে মঙ্গলবার রাতে বকাবকি করেন তার মা। রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেও বলেন। বুধবার দুপুরে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতেই সে অটোয় চেপে বালি স্টেশনে চলে যায়। মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে মা বরাহনগর থানায় অভিযোগ জানান। ওই ছাত্রীর দাবি, অটোয় চেপে বালি হল্ট স্টেশনে যাওয়ার পথে তার সঙ্গে এক তরুণীর পরিচয় হয়। বালি হল্ট পৌঁছে ওই তরুণীর সঙ্গেই হাওড়া যাওয়ার টিকিট কেটে চেপে বসে লোকাল ট্রেনে। পৌনে তিনটে নাগাদ হাওড়া স্টেশনে পৌঁছনোর পরে ওই তরুণীর সঙ্গেই উঠে পড়ে হাওড়া-মালদহ ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের মহিলা কামরায়। ওই মেয়েটি ঠিক করেছিল, এই ট্রেনে সে বালি স্টেশনে নেমে যাবে।
ওই ট্রেন অবশ্য বালি থামে না। প্রথম স্টপ ব্যান্ডেল। এর পরে বর্ধমান ও রামপুরহাট। মেয়েটির কথায়, ‘‘ঠিক করি, রামপুরহাটে সুমনের কাছেই যাব।’’ ওই তরুণীরই ফোন থেকে সুমনকে ফোন করে সে সব জানায়। বৃহস্পতিবার সুমন বলেন, ‘‘বন্ধুত্ব ছিল ঠিকই। তা বলে, এতটা বাড়াবাড়ি করবে ভাবিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম, ফোন করে মজা করছে। বারবার বলছে দেখে এক সময় ফোন কেটে দিই।’’ তাঁর দাবি, এর পরেই ওই ছাত্রীর মাকে বিষয়টি জানানোর জন্য অনেক বার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি। সে কথা স্বীকার করে এ দিন কিশোরীর মা বলেন, ‘‘তখন খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তাই ফোন ধরিনি।’’
বুধবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ সুমনকে ফের ফোন করে কিশোরী বলে, ‘‘ট্রেন এখন বোলপুরে। তুমি রামপুরহাট স্টেশন থেকে আমাকে নিয়ে না গেলে যে দিকে দু’চোখ যায়, চলে যাব।’’ সুমন এ বার চিন্তায় পড়েন। বাসে চেপে বহরমপুর থেকে রামপুরহাট রওনা দেন। রাস্তাতেই ফোনে যোগাযোগ করে ওই ছাত্রীর মাকে সব জানান সুমন। স্থানীয় পুলিশকেও সব জানান। বরাহনগর ও রামপুরহাট থানার পুলিশ সুমনের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ‘ট্র্যাক’ করে যাচ্ছিল। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ রামপুরহাট স্টেশনে পৌঁছে সুমন দেখেন, তাঁর বলে দেওয়া জায়গায় স্কুলের পোশাকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই কিশোরী। তাঁর কথায়, ‘‘কিছুতেই ওর মাকে ফোন করতে দিচ্ছিল না। একটা চুড়িদার কিনে দিই। ও বাথরুমে ঢুকতেই বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে ওর মাকে ফোন করে সব জানাই।’’ খবর পেয়ে পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে যায়।
ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ ওই কিশোরীর বাবা-মা-মামাকে নিয়ে বরাহনগর পুলিশ রামপুরহাটে পৌঁছয়। সেখানেই তাঁরা ফিরে পান নিজেদের মেয়েকে। এ দিন দুপুরে বরাহনগরের বাড়িতে বসে মা বলেন, ‘‘সামান্য বকুনিতে মেয়ে যে বাড়ি ছেড়ে দেবে, মাথাতেই আসেনি। ভাগ্যিস ও সুমনের কাছেই গিয়েছিল। ছেলেটা খুবই ভাল। তাই মেয়েকে ফিরে পেলাম।’’
অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়, বলিউড দেখার আশায় কিংবা পরিবারের বকুনিতে বাড়ি ছাড়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে, এই প্রবণতা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইদানীং আরও বেড়েছে বলেই মনে করেন মনোবিদ অমিত চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘এখন কৈশোরও এগিয়ে আসছে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে, যারা খুব শাসন বা প্রশ্রয়ের মধ্যে মানুষ হয়, এক সময়ে মুক্তি খোঁজে। তা করতে গিয়েই তারা কোনও আত্মীয় নয়, বরং অনাত্মীয়ের কাছে যেতে চায়। এটা তাদের তাৎক্ষণিক ইচ্ছা। কিন্তু, এই কাণ্ড করতে গিয়ে তাদের যে বড় বিপদও হতে পারে, তা মাথায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে ওই যুবক যে সততার পরিচয় দিয়েছেন, তা সত্যিই ব্যতিক্রম।’’
সুমন নিজে অবশ্য বিরাট কিছু করেছেন বলে মানছেন না। বরং বারবারই বলছেন, ‘‘দিনকাল খারাপ। পথে যে ওর কোনও বিপদ হয়নি, এটাই রক্ষে!’’