‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে। যে রাজনৈতিক দলগুলি পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মতামত জানায়, সেই ‘সরব গণতন্ত্র’ রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে একেবারেই নীরব। কারও পক্ষ নিতে দেখা যাচ্ছে না। কারও ‘আগ্রাসন’-এর বিপক্ষেও কোনও বিবৃতি নেই। যেটুকু বিবৃতি, তা হল নিরাপদ ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’। তাতেই শান্তি!
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের বেশিরভাগ জনমত ইউক্রেনের পক্ষে রয়েছে। যেমন অসম যুদ্ধে বরাবর থেকেছে। বাঙালিও আগাগোড়া ‘আন্ডারডগ’-এর প্রতি সহানুভূতিশীল থেকেছে। যে কারণে সিপিএমের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ে জনতার সহানুভূতি আদায় করে নিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই। বাংলার রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পথে হেঁটেছে। কিন্তু ইউক্রেনের লড়াই সে ভাবে কোনও সহানুভূতি পাচ্ছে না বাংলার রাজনৈতিক দলগুলির। সে শাসকই হোক বা বিরোধী।
রাশিয়ার ‘আগ্রাসন’-এর বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে কোনও মিছিল হয়নি সোমবার পর্যন্ত। ইউক্রেনে আটকে-পড়া পড়ুয়াদের দেশে ফিরিয়ে আনতে অবশ্য মিছিল করেছে শাসক তৃণমূল। কিন্তু দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষকে প্রশ্ন করলে তিনি শুধু বলছেন, ‘‘আমাদের অবস্থান হল— যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। যাঁরা ইউক্রেনে আটকে পড়েছেন, তাঁদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।’’ তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘‘আমরা চাই ইউক্রেনে থাকা ভারতীয়দের নিরাপত্তা। কিন্তু কেন্দ্র যে পথে চলছে, সেটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা কেন্দ্রের এই ব্যর্থতার বিরুদ্ধে।’’ কিন্তু যুদ্ধ নিয়ে কী বক্তব্য? সৌগতর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘আমরা সব রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে।’’ প্রসঙ্গত, সোমবারই ইউক্রেন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু দলের তরফে রাশিয়া বা ইউক্রেন— কারও পক্ষ নেওয়ার কথা বলা হয়নি। বস্তুত, সোমবার বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বইমেলার উদ্বোধনে গিয়ে বলেন, ‘‘আমরা কোনও দেশের পক্ষেই নই। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে লিখেছি, ভারত যেন দু’দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপনে উদ্যোগী হয়।’’
বাংলার বিজেপি বলছে, দেশের সরকারের পথই তাদের পথ। একই পথে প্রদেশ কংগ্রেস আর বাংলার সিপিএম। তারা বলছে, এআইসিসি এবং পলিটব্যুরো সব জানে।
কুয়েত, ইরাক থেকে ভিয়েতনাম বা ভেনেজুয়েলা— অতীতে যে কোনও পরিস্থিতিতে যুদ্ধ-বিরোধিতায় বড় বড় মিছিল দেখেছে কলকাতা। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে সেই ‘সক্রিয়তা’ নেই। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই বিদেশনীতি বিষয়ক একটি শাখা থাকে। সে শাখাগুলিও ‘নিষ্ক্রিয়’।
আমেরিকার ‘সাম্রাজ্যবাদ’-কে আক্রমণ করা বামপন্থীরা কি রাশিয়া বলেই এত চুপচাপ! দলের পলিটব্যুরো যে বার্তা দিয়েছে, তা-ও খানিকটা ভাসা ভাসা। ‘শান্তিই অগ্রাধিকার’ শীর্ষক ১১ লাইনের বিবৃতিতে সিপিএম পলিটব্যুরো ঘটনাপ্রবাহে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি, আগ্রাসনের পক্ষে রাশিয়ার যুক্তিকেও ঘুরিয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে সে দেশে আটকে-পড়া ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপদে উদ্ধারের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে আবেদন করা হয়েছে। কোথাও কর্মী-সদস্যদের পথে নামার আহ্বান নেই। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে, পলিটব্যুরোর ইউক্রেন সংক্রান্ত সেই বিবৃতির স্থান হয়নি পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের ফেসবুক বা টুইটার পেজে! রাশিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলেও পুতিনের দেশ নিয়ে ‘দুর্বলতা’ থেকেই কি এমন ভূমিকা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের?
সিপিএমের রাজ্য নেতা তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে পলিটব্যুরো যা বিবৃতি দিয়েছে, সেটাই শেষ কথা। আন্তর্জাতিক বিষয় হলে সেটা নিয়ে পলিটব্যুরোই শুধু কথা বলার অধিকারী। তবে ইউক্রেন নয়, বাংলায় পুরভোট নিয়ে যে যুদ্ধের পরিস্থিতি, সে দিকে বেশি করে নজর দেওয়া দরকার।’’
বিজেপি-র নেতা শিশির বাজোরিয়ার কথায়, ‘‘বিজেপি তৃণমূলের মতো নয়। এ রাজ্যে সরকার আর শাসকদল এক। কিন্তু আমরা সেটা নই। মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রের সরকার বিজেপি-র নয়। ভারতের সরকার। সকলের সরকার। তাই দিল্লি যে সিদ্ধান্ত নেবে বা পদক্ষেপ করবে, বাংলায় আমরা তার সঙ্গেই রয়েছি।’’ কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার থাকলেও একই নীতিতে চলত বিজেপি? শিশিরের জবাব, ‘‘এটা কাল্পনিক প্রশ্ন। এর কোনও উত্তর দেব না।’’
প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এই বিষয়ে দিল্লির বক্তব্যই শেষ কথা। পাশাপাশিই তিনি জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের জওহরলাল নেহরুর দেখানো পথেই চলা উচিত। রাজ্যসভার সাংসদ প্রদীপের কথায়, ‘‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এআইসিসি-র অবস্থানই আমাদের অবস্থান। তবে ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও মানবিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ভাল। তাই এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান এমন হওয়া উচিত, যাতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কও নষ্ট না হয়। সঙ্গে আগ্রাসন নীতিরও বিরোধিতা করা যায়। নেহরু যে ভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সামাল দিতেন।’’ বিজেপি অবশ্য মনে করে ঠিক পদক্ষেপই নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। শিশিরের কথায় বলেন, ‘‘বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিশালী বিদেশনীতির জন্যই আমেরিকা এবং রাশিয়া— দু’দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক এত মজবুত।’’