শোকাহত ধর্মা রাওয়ের স্ত্রী ও পুত্র। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
বছর দুয়েক আগে অসুখে মারা গিয়েছিল তিন মাসের মেয়ে।
১১ দিন আগে মারা গিয়েছিল প্রিয় পোষ্য ‘শ্যাডো’।
দু’টি মৃত্যুই অস্থির করে তুলেছিল খড়্গপুরের ‘রেল মাফিয়া’ শ্রীনু নায়ডুকে। সে আঁকড়ে ধরেছিল সাত বছরের ছেলে তরুণ এবং বাকি চার পোষ্য রোজি-রক্সি-রুবি-সুইটিকে। কিন্তু বুধবার বিকেলে তরুণ হারাল বাবাকে। রোজি-সুইটিরা হারাল তাদের মনিবকে।
দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়েছে শ্রীনু— বুধবার এই খবর ছড়াতেই খড়্গপুরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নিউ সেটলমেন্ট এলাকায় শ্রীনুর রেল কোয়ার্টারে ভিড় জমতে থাকে। বৃহস্পতিবার সেই ভিড় আরও বাড়ে। থেকে থেকে কান্নার রোল ওঠে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিল একরত্তি ছেলেটা। সবাই আছে। বাবা নেই। ছেলেটা বাবাকে খুঁজছিল। তাকে আগলে রাখছিলেন আত্মীয়েরা।
ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে এ দিন থেকেই চিন্তায় ডুবে গিয়েছেন শ্রীনুর স্ত্রী, ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর পূজা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘‘মেয়ের মৃত্যুর পর থেকেই শ্রীনু বদলে গিয়েছিল। ও চাইত তরুণ নতুন জীবন পাক। খোলা আকাশ দিতে চেয়েছিল ছেলেকে। বলত প্রতিদিন ওকে স্কুলে পাঠাবে। শ্রীনু ভাল করে বাঁচতে চেয়েছিল বলেই ওকে এত সহজে মারতে পারল। আমি শ্রীনুকে ছাড়া তরুণকে কী ভাবে মুক্ত আকাশ দেব?”
বুধবার বিনিদ্র রাত কেটেছে বাড়ির সকলেরই। চার ভাইয়ের মধ্যে শ্রীনু ছোট। তিন বোন রয়েছেন। বড় ভাই এস বি নায়ডু আগেই মারা গিয়েছেন। মেজো ভাই এ ভোগেশ্বরের ওই এলাকাতেই পানের দোকান রয়েছে। সেজো ভাই চিন্না বেকার। বোনেদের মধ্যে রাম বাঈয়ের বিয়ে হয়েছে। লক্ষ্মী বাঈ এবং এ ভাগ্যলক্ষ্মী এখনও অবিবাহিত। ছেলের খুন হওয়ার কথা শুনে বৃহস্পতিবারই অন্ধ্রপ্রদেশের আঙ্কাপল্লির ‘দেশের বাড়ি’ থেকে খড়্গপুরে ফেরেন শ্রীনুর মা রাবণাম্মাদেবী। শোকে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। তার মধ্যে খুনিদের চরম শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘শ্রীনু ভাল হয়ে গিয়েছিল। মানুষের উপকার করত। শুধু বলত, চিন্না আর দুই বোনের ব্যবস্থা করতে পারলে আমি সবচেয়ে সুখী হব। এ ভাবে ওকে খুন করা হবে ভাবতে পারিনি।’’
বাবা যে আর নেই, তরুণ তা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও রোজি, রক্সি, রুবি, সুইটিরা বুঝি টের পেয়ে গিয়েছিল বুধবার রাতেই। শ্রীনুর অতি প্রিয় চার সারমেয়। পরিবারের লোকজন জানান, সারারাত চার পোষ্য ছটফট করেছে। খেতে চায়নি। কেঁদেছে। এদের মধ্যে শ্রীনুর সবচেয়ে প্রিয় ছিল রটওয়েলার প্রজাতির কুকুর, ছ’বছরের রোজি। বাকি দু’টি পিটবুল প্রজাতির, সুইটি ল্যাব্রাডর।
কলকাতার হাসপাতালে শ্রীনুর দেহ। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।
কোয়ার্টার থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরে যে তৃণমূল কার্যালয়ে শ্রীনু খুন হয়, তার উল্টোদিকেই সে নতুন জিম বানিয়েছিল। তার বাইরে চারটি খাঁচায় থাকত কুকুরগুলি। প্রতিদিন সময় করে পোষ্যদের সঙ্গে খুনসুটি অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল শ্রীনুর। তার ঘনিষ্ঠেরা জানান, বাইরে কাজে থাকলেও ফোন করে পোষ্যদের খোঁজ নিত শ্রীনু। বছরের শুরুতেই মৃত্যু হয় রটওয়েলার প্রজাতির কুকুর, মাস তিনেকের শ্যাডোর। সেই মৃত্যুতে অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
গোটা পাড়াই কার্যত শোকস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। বাইরের লোকের কাছে শ্রীনু ‘মাফিয়া’ হলেও পাড়ায় ‘মসিহা’ ছিল। অনেকের মুখেই তার নানা উপকারের কথা শোনা গিয়েছে। সকাল থেকেই তার বাড়িতে দফায় দফায় ঘুরে গিয়েছেন কয়েক জন কাউন্সিলর। আসেন পুরপ্রধান প্রদীপ সরকারও। শ্রীনুর সঙ্গে খুন হওয়া তার ‘ডান হাত’ ধর্মা রাওয়ের স্ত্রী বি রোজা বলেন, ‘‘শ্রীনু স্বামীকে মাসে ১২ হাজার টাকা দিত। সেই টাকায় সংসার চলত। এ বার চার মাসের ছেলেকে নিয়ে কী ভাবে বাঁচব?’’
ময়না-তদন্তের পরে এ দিন রাতে শ্রীনু ও তার শাগরেদ ধর্মার দেহ খড়্গপুরে আসে। দেহ দু’টি রাখা হয় রেল হাসপাতালের মর্গে। আজ, শুক্রবার দাহ হওয়ার কথা। শ্রীনুর এক শাগরেদ বলে, ‘‘এ লাইনে একবার এলে আর ফেরা যায় না। এখান থেকে ফেরা মানে পুরোপুরি মুক্তি। শ্রীনুও চেষ্টা করে পারল না।’’