সেই দৃশ্য।
শিউরে উঠেছে শহর। সচেতন সামাজিক থেকে পুলিশের শীর্ষ মহল পর্যন্ত সকলে স্তম্ভিত, মর্মাহত। কিন্তু মাটিতে এক যুবককে পেড়ে ফেলে বুকে বুট-পরা পা দিয়ে চেপে ধরে এক ‘গ্রিন পুলিশ’ বা সিভিক ভলান্টিয়ারের মারধরের ঘটনায় বিন্দুমাত্র লজ্জিত নন অভিযুক্তের সহকর্মীদের একাংশ। উল্টে অভিযুক্ত গ্রিন পুলিশকর্মীর সমর্থনে রীতিমতো সরব হয়েছেন তাঁরা। মূল ঘটনায় আমজনতা যত বিস্মিত, অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ারের পাশে দাঁড়ানো ওই সহকর্মীদের ভূমিকায় তার থেকে কম হতবাক নন তাঁরা।
নাগরিকদের একাংশের বক্তব্য, এমন ঘটনা দেশের অন্য রাজ্যেও সচরাচর দেখা যায় না। উত্তরপ্রদেশ বা অন্য রাজ্যের পুলিশের অমানবিক ব্যবহার নিয়ে সমালোচনায় মুখর এই বাংলারই গ্রিন পুলিশকর্মী তন্ময় বিশ্বাস কী ভাবে এমন আচরণের শিক্ষা ও সাহস পান, সেই প্রশ্ন তো উঠছেই। সেই প্রশ্নকে ছাপিয়েও প্রশ্ন উঠছে, তন্ময়ের সহকর্মীদের একাংশ যে তাঁর আচরণ সমর্থন করছেন, তাতে কি এই ভয়াবহ সত্যই প্রকট হচ্ছে না যে, এটা কোনও একক তন্ময়ের মানসিকতা নয়? রোগটা তলে তলে ছড়িয়েছে অনেক দূর? এমন সন্দিগ্ধ প্রশ্নও শোনা যাচ্ছে যে, এই সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজে কাদের নিয়োগ করা হচ্ছে? সহ-নাগরিকদের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল তাঁরা? তাঁদের যে-ধরনের কাজে নিয়োগ করা হয়েছে, তাতে প্রতি মুহূর্তে সহৃদয় জনসংযোগের প্রয়োজন। মার্জিত, ভদ্র ব্যবহার জরুরি। কলকাতার পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্রের সখেদ মন্তব্য, এই ধরনের ঘটনা পুলিশের ভাল কাজগুলোকে অর্থহীন করে দেয়। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি পুলিশকর্তাদের বার্তা ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না গ্রিন পুলিশের কাছে?
কী ভাবে তন্ময়ের সমর্থনে নেমেছেন তাঁর কিছু সহকর্মী? একটি উদাহরণই যথেষ্ট। তন্ময়ের এক সহকর্মী সিভিক ভলান্টিয়ার সোমবার বলেন, ‘‘এই নেশাখোর ছিনতাইবাজেরা নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ওরা মুখের মধ্যে ব্লেড রেখে দেয়। প্রয়োজনে মুখ থেকে বার করে চালিয়ে দেয়। ওই লোকটি (রবিবার যাঁর বুকে বুট-পরা পা তুলে দিয়েছিলেন তন্ময়) ব্লেড চালিয়ে দিলে কী হত? তাই হয়তো সাবধান হয়ে হাত দিয়ে ওই ছিনতাইবাজকে ধরতে চায়নি তন্ময়। হয়তো আশঙ্কা করেছিল, পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সে রক্তারক্তি ঘটাতে পারে!’’
কারা ওঁদের নিয়োগ করেন? এই প্রশ্নের জবাবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখুন, এই সিভিক ভলান্টিয়ারদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক দলের মদতে পুষ্ট। যখনই ওঁদের নিয়োগ করার সময় হয়, তখনই রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছ থেকে তালিকা চলে আসে। ফলে এই সিভিক ভলান্টিয়ারদের অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। মনে করেন, পিছনে সব সময়েই ‘দাদা-দিদিদের’ সমর্থন রয়েছে। এত দিন ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং ওয়ার্কশপ করেও তাঁদের মানসিকতা বদল করা যায়নি।’’
কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, ভাল কাজ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন সাউথ ট্র্যাফিক গার্ডের সিভিক ভলান্টিয়ার তন্ময়। তাঁদের মতে, ওই ছিনতাইবাজের বুকে লাথি মারার আগে দুই মহিলার টাকা ও মোবাইল উদ্ধার করার মতো ভাল কাজও তো করেছেন তন্ময়। তবে বুকে লাথি মারার কাজটা তিনি ঠিক করেননি বলেই তাঁদের অভিমত।
এ দিকে, শেক্সপিয়র সরণি থানার পুলিশ জানিয়েছে, মহম্মদ জাফর নামে অভিযু্ত ছিনতাইবাজকে গ্রেফতার করে সোমবার আদালতে তোলা হয়। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে তিনি আগেও কয়েক বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন।
পুরো ঘটনার ভিডিয়ো তুলেছিলেন পৃথ্বী বসু নামে এক ব্যক্তি। পৃথ্বীবাবু সেই সময় এক্সাইড মোড়ে বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি যা দেখেছি, তাতে এক বারও মনে হয়নি যে, ওই অভিযুক্ত পুলিশের হাত ছাড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে পালাতে পারত! ওর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরলেই সে আর নড়তে পারত না। বুকে লাথি মারার কোনও দরকারই ছিল না।’’
প্রশ্ন উঠছে জনতার অসাড়তা নিয়েও। প্রশ্ন উঠছে, লোকটির বুকে-পেটে যখন লাথি মারা হচ্ছিল, তখন কোনও পথচারী প্রতিবাদ করেননি কেন? অনেকেই ঘটনার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু কেউ নিগৃহীতকে বাঁচাতে যাননি। কেন?
পৃথ্বীবাবু বলেন, ‘‘ঘটনাটি একেবারেই আকস্মিক ভাবে ঘটে যায়। কেউ কোনও প্রতিবাদ করার আগেই শুরু হয়ে যায় মারধর। কিছু ক্ষণের মধ্যেই অবশ্য আরও কিছু পুলিশকর্মী চলে আসেন। তাঁরা অভিযুক্তকে উদ্ধার করে ফুটপাতে বসিয়ে রাখেন।’’