বঙ্গ রাজনীতির তিন হুমায়ুন কবীর। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রথম জন যেমন গুরুত্ব নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, তেমনটা আর থাকতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। দ্বিতীয় জন আইপিএসের চাকরি ছেড়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু এখন শুধুই বিধায়ক। তৃতীয় জন এত বার দল এবং পক্ষ বদলেছেন যে, এখন তাঁকে আর সে ভাবে গুরুত্ব দেন না কেউ।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সঙ্গে ‘হুমায়ুন কবীর’ নামের যোগ সুপ্রাচীন। আপাতত যাঁকে নিয়ে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের আগে শাসক শিবিরের রাজনীতিতে খানিক তরঙ্গ উঠেছে, তিনি মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন কবীর। যিনি দলবদলের মতোই অবস্থানও বদলে ফেলেন ঘন ঘন। আজ এই বলছেন, তো কাল ওই বলছেন। পরশু কী বলবেন, সম্ভবত তিনি নিজেও জানেন না। নিত্য রাজনৈতিক হুঁশিয়ারি দেন। নির্বাচনের আগে তার পরিমাণ বাড়ে। কখনও জেলার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আবার কখনও রাজ্যনেতৃত্বের বিরুদ্ধে। পর দিনই আপস করে নেন। তার পর রাত পোহাতেই ফের ফুঁসে ওঠেন!
মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন
বাড়ি রেজিনগরে। কংগ্রেসের টিকিটে রেজিনগর থেকে বিধায়ক ছিলেন। মাঝপথে ছেড়ে দেন। সেটা ২০১৩ সাল। তৃণমূলের টিকিটে উপনির্বাচনে লড়েন এবং হারেন। আপাতত তিনি ভরতপুর থেকে তৃণমূলের বিধায়ক। অন্তত খাতায়কলমে। আদতে কোন দলের, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কারণ, তাঁর সেই পরিচয় খানিক অনিশ্চিত। রাজনীতির আলো এবং ক্ষমতার বৃত্তে থাকতে তিনি বার বার দল বদলেছেন।
নব্বইয়ের দশকে বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীর হাত ধরেই মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে উত্থান। ১৯৯৯ সালে যাঁদের উপর ভরসা করে অধীর প্রথম বার সাংসদ হন, তাঁদের এক জন হুমায়ুন। ২০১১ সালে অধীরের প্রতি আনুগত্যের ‘পুরস্কার’ হিসেবে রেজিনগর থেকে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রার্থী হন হুমায়ুন। প্রথম বারেই জয় পান।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ভেঙে যায়। তৃণমূল সরকার থেকে কংগ্রেসের পাঁচ মন্ত্রী পদত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। শোনা যায়, তখন ইংরেজবাজারের কংগ্রেস বিধায়ক কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে রেজিনগরের বিধায়ক হুমায়ুনকেও মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিল তৃণমূল। ২০১২ সালের নভেম্বরে কৃষ্ণেন্দু-হুমায়ুন দু’জনেই তৃণমূলে যোগ দেন। মন্ত্রিত্ব পেতে দেরি হয়নি। প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের প্রতিমন্ত্রী হন হুমায়ুন। তবে ছ’মাস পরে নিয়ম মেনে বিধায়ক পদ ছেড়ে উপনির্বাচনে জিততে হত। কৃষ্ণেন্দু জিতেছিলেন। হুমায়ুন হেরেছিলেন।
উপনির্বাচনে হারার পর দলের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন হুমায়ুন। ‘মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ভাইপোকে রাজা করতে চান’ মন্তব্য করে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের রোষানলেও পড়েন। ২০১৫ সালে তাঁকে সাসপেন্ড করে তৃণমূল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রেজিনগর কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হন হুমায়ুন। হাজার তিনেক ভোটে কংগ্রেসের রবিউল চৌধুরীর কাছে হেরে যান। কিন্তু রবিউল কিছু দিন পরেই তৃণমূলে যোগ দেন। ফলে হুমায়ুনের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন আরও কঠিন হয়ে যায়।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে পুরনো ‘রাজনৈতিক গুরু’ অধীরের প্রস্তাবে কংগ্রেসে ফেরেন হুমায়ুন। ২০১৮ সালে কংগ্রেসের হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় পঞ্চায়েত ভোটে নেতৃত্বও দিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু হুমায়ুনের কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তনও স্থায়ী হয়নি। ২০১৮ সালে কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থীও হন। হারেন। পরের বছরই বিজেপি ছাড়েন। ২০২১ সালের ভোটের আগে আবার তৃণমূলে। তবে এ বার আর রেজিনগরে নয়। ভরতপুরে। জিতেও যান।
তবে বিধায়ক হলেও ‘দলবদলু’ হুমায়ুন কোনও দিনই তৃণমূলে সাংগঠনিক গুরুত্ব পাননি। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের আবহে আবার তিনি দলকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিতে শুরু করেছেন। জেলার আরও তিন বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। চ্যানেলে চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। তবে দলবদলের মতোই অবস্থান বদলের ক্ষেত্রেও সমান পারদর্শী হুমায়ুন। কখনও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, জেলায় তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা ২০ থেকে দুই-এ নামিয়ে আনবেন। কখনও জেলা তৃণমূল সভাপতি শাওনি সিংহরায়ের অপসারণের দাবিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার পাল্টা সভা করার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু ‘ধমক’ খেয়ে গুটিয়ে গিয়েছেন। সভা বাতিল করলেও ভাষণ বন্ধ করেননি। তবে এ বার আর দলবদলের ‘আওয়াজ’ নেই। হুমায়ুনের সর্বশেষ হুঁশিয়ারি, ‘‘সমস্যার সমাধান না হলে তৃণমূলে থেকেই কী ভাবে আন্দোলন করে শুদ্ধিকরণ করতে হয়, তা জানি।’’ দলের লোকেরা অবশ্য সন্দিহান— তৃণমূলে থেকেই?
আইপিএস থেকে রাজনীতিক হুমায়ুন
প্রাক্তন আইপিএস হুমায়ুন কবীর গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম বার বিধায়ক হন। হয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃতীয় তৃণমূল সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়ে যান। যদিও তার মেয়াদ বেশি দিন ছিল না। কিছু ব্যক্তিগত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় তাঁকে মন্ত্রীর পদ খোয়াতে হয় বলেই প্রশাসনের অন্দরে খবর। যদিও এর আনুষ্ঠানিক কোনও সত্যতা কখনওই পাওয়া যায়নি।
বাম জমানায় শাসকদলের ‘ঘনিষ্ঠ’ পুলিশকর্তা হিসেবেই হুমায়ুনের পরিচিতি ছিল। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে তাঁকে মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। শোনা যায়, সেই সময়ে তাঁর কাজে বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। কর্মজীবন শেষ হওয়ার চার মাস আগে ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি আচমকাই চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। শোনা যায়, সেই সময়ে আরও কয়েক জন আইপিএস এবং আইএএস আধিকারিককে তৃণমূলে যোগদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে সকলে পিছিয়ে গেলেও হুমায়ুন এগিয়ে আসেন। যোগ দেন তৃণমূলে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা আসনে হুমায়ুনকে প্রার্থী করেন মমতা। বিরুদ্ধে আর এক প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষ। হুমায়ুন ভারতীকে হারান। কারিগরি শিক্ষা দফতরের মন্ত্রীও হন। কিন্তু এখন মন্ত্রিত্ব হারিয়ে শুধু বিধায়ক। দলেও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলে শোনা যায় না। দলের অনেকে বলেন, কলকাতার বাড়িতে বসেই নাকি ডেবরা সামলান তিনি। তবে তাঁর হিতৈষীরা জানাচ্ছেন, একেবারেই না। বিধায়ক হিসেবে কেন্দ্রে নিয়মিত যান হুমায়ুন।
নেহরুর মন্ত্রী হুমায়ুন
তিনিও হুমায়ুন কবীর। রাজ্যের সাংসদ ছিলেন। জওহরলাল নেহরু মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও থেকেছেন। শেষ জীবনে অবশ্য কংগ্রেস ছেড়ে বাংলা কংগ্রেসে গিয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও অনেক ওঠাপড়া। বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোমারপুরে জন্ম ১৯০৬ সালে। লেখাপড়ার সূত্রে কলকাতায় আগমন। তখনকার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করেন তৃতীয় স্থান পেয়ে। এর পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া এবং দুর্দান্ত রেজ়াল্ট। এর পরে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের ডাকে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ। শিক্ষাবিদ হিসেবে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কেন্দ্রের শিক্ষাসচিব থেকে শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান। নেহরু মন্ত্রিসভার পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন এই হুমায়ুন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে মাদ্রাজের রাজ্যপালের পদে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে অনুরোধ উপেক্ষা করেন।
একটা বড় সময় রাজ্যসভায় কংগ্রেস সাংসদ হুমায়ুন বসিরহাট লোকসভা আসনেও জিতেছিলেন কংগ্রেসের টিকিটে। কিন্তু সেটা পাঁচ বছরের জন্য। ১৯৬৭ সালে তিনি মূল কংগ্রেস থেকে সরে গিয়ে বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হন। অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জিতেওছিলেন। কিন্তু পুরো মেয়াদ সাংসদ থাকতে পারেননি। ১৯৬৯ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্বের সঙ্গে শুরু করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত আর তত গুরুত্বপূর্ণ থাকেননি।
প্রসঙ্গত, আরবি ভাষায় ‘হুমায়ুন’ শব্দটির অর্থ ‘ভাগ্যবান’। রাজনীতির বৃত্তের বাইরেও আর এক হুমায়ুন রয়েছেন। তিনি ইতিহাসের হুমায়ুন। মোগল সম্রাট বাবরের পুত্র। সম্রাট আকবরের পিতা। তাঁর সঙ্গেও বাংলার সম্পর্ক থেকেছে। তবে তাঁর নামের সঙ্গে ‘কবীর’ নেই।
বাবর-পুত্র হুমায়ুন
পিতা বাবর এবং পুত্র আকবরের তুলনায় রাজনৈতিক গুরুত্বের বিচারে পিছিয়ে দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুন। আসল নাম নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুই দফায় আধুনিক আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন এই হুমায়ুন।
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৩ বছর বয়সে পিতৃ মনোনয়নে হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তার আট বছর পর তাঁর সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের যোগাযোগ। ইতিহাস বলছে, ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে সসৈন্য গৌড়ে প্রবেশ করেন হুমায়ুন। গঙ্গাপারের গৌড়ের মনোরম পরিবেশ তাঁকে আলোড়িত করে। প্রীত হয়ে তার নাম বদলে করেন ‘জন্নতাবাদ’ (জন্নত শব্দের অর্থ স্বর্গ)। কিন্তু তাঁকে তৎকালীন গৌড়ের শাসক শের শাহের কৌশল আর দূরদর্শিতার কাছে হারতে হয়। শের শাহ সম্মুখসমরে অবতীর্ণ না হয়ে হুমায়ুনকে গৌড় দখলের সুযোগ করে দেন। অন্য দিকে নিজে সমগ্র বিহার দখল করে বসেন। এমনকি, জৌনপুর ও কনৌজ অধিকার করে হুমায়ুনের বাংলা থেকে আগরায় প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ করে দেন। ১৫৩৯ সালে আগরা যাওয়ার পথে বক্সারের নিকটবর্তী চৌসায় শের শাহ ও তাঁর আফগান অনুচরেরা হুমায়ুনের বাধা হয়ে দাঁড়ান। তীব্র যুদ্ধে হুমায়ুন শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন। শের শাহের নেতৃত্বে আফগান বাহিনী মোগল বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অনেক সৈন্য গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেকেরই সলিলসমাধি হয়। তবে ‘নিজাম’ নামে এক ভিস্তিওয়ালার সহায়তায় সম্রাট হুমায়ুন প্রাণে বাঁচেন।
তার পরেও হুমায়ুন সম্রাট থেকেছেন ১৫৫৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু মৃত্যুও তাঁকে গুরুত্ব দিতে পারেনি। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরগতি নয়, সিঁড়ি থেকে পড়ে আহত হয়ে মারা যান মোগল সম্রাট হুমায়ুন।