এই শহরেই ৫১ বছর আগের এক হেমন্তে নতুন দলের মঞ্চ গড়ে তুলতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। সেই শহরেই অদ্ভুত শৈত্য নেমে এল তাঁর উপরে! তার জেরে প্লেনামের মঞ্চ থেকে নেমেই যেতে হল সিপিএমের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যকে!
দলের মধ্যে তাঁর আনুষ্ঠানিক আসন যা-ই হোক, ভেলিক্কাকাথু শঙ্করন অচ্যুতানন্দনের মর্যাদা এখনও অনন্য! সে কথা মাথায় রেখেই এ বার কলকাতা প্লেনামের মঞ্চে কেরলের বিরোধী দলনেতাকে ডেকে নিয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। একই ব্যবস্থা ছিল রবিবারের ব্রিগে়ড সমাবেশেও। কিন্তু গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের সমীকরণ কবে আর ইতিহাস, মর্যাদার খেয়াল রেখেছে! তাই প্রবল আপত্তি তুলেছেন পিনারাই বিজয়নেরা। কেরলের ওই বিজয়ন-শিবির সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এমনই প্রভাবশালী যে, তাঁদের গোঁসার চোটে প্লেনামের মঞ্চ থেকে মাথা নিচু করে নেমে যেতে হয়েছে নবতিপর ভি এস-কে! প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে প্লেনামের প্রতিনিধিদের আসনের প্রথম সারিতে এখন বসতে হচ্ছে তাঁকে।
বাংলার নেতারা অবশ্য সুযোগ পেলেই তাঁর কাছে গিয়ে সহমর্মিতা জানিয়ে আসছেন, ভি এসের পাশে বসে ছবি তুলছেন। আর কেরলের জনপ্রিয়তম সিপিএম নেতার হাল দেখে নিজেকে মঞ্চ থেকে দূরে রাখছেন আর এক জন! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনের প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে মঞ্চের ঠিক লাগোয়া ছোট্ট সাজঘরে বসছেন এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। যেখান থেকে সব শোনা যাবে, দেখা যাবে। কিন্তু কেন বসেছেন বলে কেউ প্রশ্ন করবে না!
বুদ্ধবাবু মঞ্চে উঠলে কেউ তাঁকে প্রশ্ন করতে যেত, সিপিএমের মধ্যে পরিস্থিতি অবশ্যই এমন নয়! তবু নিজের মতো করে দূরত্ব রাখছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেতার বক্তব্য, ‘‘বুদ্ধদা এখন আর দলের পলিটব্যুরোয় নেই, কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমন্ত্রিত। রাজ্য স্তরেও সব পদ ছাড়তে চেয়েছেন আগেই। পদাধিকার বলে কোনও জায়গা না ধরে রেখে তিনি বরং সরে যাওয়ারই পক্ষপাতী।’’ এর সঙ্গে যে কথাটা ওই নেতা সরাসরি বলেননি— ভি এসের অভিজ্ঞতা সম্ভবত বাড়তি সতর্কও করে দিয়ে থাকবে বুদ্ধবাবুকে!
কেরলের নেতাদের যুক্তি, পার্টি কংগ্রেস বা প্লেনামের মঞ্চ শুধুই দলের পলিটব্যুরো সদস্য এবং সভা পরিচালনার সভাপতিমণ্ডলীর জন্য। এ বারের প্লেনামে যেমন সভাপতিমণ্ডলীর নেতৃত্বে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। সঙ্গে আছেন রামচন্দ্র ডোম, এলামেল্লম করিম, জিতেন্দ্র চোধুরী এবং ইউ বাসুকী। প্রত্যেকেই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ভি এস এখন কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য মাত্র। মঞ্চের উপরে চাঁদের হাটে তাঁর জায়গা কেন হবে, প্রশ্ন তুলেছেন বিজয়নেরা! দলের একাংশের বক্তব্য, তাতে নীরব সায় ছিল প্রকাশ কারাটদেরও। অতএব, প্রস্থানের পথ ধরেছেন ভি এস!
মঞ্চের উপরে মধ্যমণির আসন থেকে গোটাটাই দেখছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরি। তিনি ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। কিন্তু পলিটব্যুরোর চক্রব্যূহে এখনও তিনি অভিমন্যুর মতো! এই নিয়ে তিনি শুধু এটুকুই বলেছেন, ‘‘মঞ্চে কে কোথায় বসবেন, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কোনও নির্দেশিকা ছিল না।’’ সিপিএম সূত্রের খবর, ভি এসের কাছে ‘ব্যক্তিগত ভাবে’ দুঃখপ্রকাশও করেছেন সাধারণ সম্পাদক। আর মরিয়া হয়ে কেরল রাজ্য নেতৃত্বকে নির্দেশ দিয়েছেন, ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের জন্য তাঁরা যেন এখন থেকে কাউকে মুখ্যমন্ত্রী-পদপ্রার্থী (পড়ুন, বিজয়ন) ঘোষণা করতে না যান!
কয়েক মাসের মধ্যে কেরলে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বাম জোটের ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা প্রবল। তার আগে প্লেনামের আসরেও গোষ্ঠী-বিভাজনের এমন তিক্ত প্রভাব দল সম্পর্কে যে ভাল বার্তা দিচ্ছে না, বুঝতে পারছেন ইয়েচুরি। বিশেষত, ১৯৬৪ সালে তদানীন্তন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদ থেকে ওয়াকআউট করে যে ৩২ জন নেতা এই কলকাতার ত্যাগরাজ হলে পার্টি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন এবং আলাদা দল হিসাবে সিপিএম প্রতিষ্ঠার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবিত ও সক্রিয় আছেন শুধু ভি এস-ই। তাঁর সঙ্গেই এমন ব্যবহার হতবাক করে দিয়েছে অনেককেই!
ভি এস অবশ্য মুখের হাসিটা ধরে রেখেছেন। প্লেনামের বাইরে জানিয়ে দিয়েছেন, ফের ভোটে লড়বেন কি না, এখনও ঠিক করেননি। তবে বিজয়নেরা জানেন, এই ‘বুড়ো’ লড়াই ছাড়ার বান্দা নন! তাই যতো পারো, বৃত্তের বাইরে ঠেলো তাঁকে!