সবংয়ের সজনীকান্ত কলেজের ছাত্র পরিষদ কর্মী, তৃতীয় বর্ষের ছাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ জানাকে পিটিয়ে হত্যা করার পৈশাচিক ঘটনায় সকল রাজ্যবাসীর মতো আমিও স্তম্ভিত। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নেই। রাজ্য জুড়ে, বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চলেছে, এই ঘটনা নিঃসন্দেহে তার সাম্প্রতিকতম চরম নিদর্শন।
রাজ্য জুড়ে তৃণমূল ছাত্র কংগ্রেসের শিক্ষায়তন দখলের কার্যক্রম দুর্বার গতিতে এগোলেও সবংয়ের ওই কলেজের ইউনিয়ন ছাত্র পরিষদের দখলেই ছিল। টিএমসিপি-র লাগাতার চাপ কাজে দেয়নি।
এ দিনও জলসম্পদ মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রর অভ্যর্থনায় জোর করে ছাত্র পরিষদকে সামিল করার
চেষ্টা করছিল তারা। এতে বাধা দেওয়ার পরিণতিতেই কৃষ্ণপ্রসাদকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনায় সারা রাজ্য এখন উত্তাল। মানুষের এই প্রতিক্রিয়া কোনও ভাবেই অভাবিত নয়। বহিরাগত মস্তান বাহিনীর হামলা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মানুষজন এতে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছেন। সবংয়ের ঘটনা মস্তান বাহিনীর দাপটের বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, ষাটের দশকে জঙ্গি ছাত্র আন্দোলনও মাঝে মাঝেই হিংস্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেখানেও ছাত্রদের হানাহানির সুযোগে বহিরাগত দুষ্কৃতীরা কোনও ছাত্রকে হত্যা করবে, এটা অকল্পনীয় ছিল। ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, কিন্তু তা কোনও সময়েই ছাত্র-হত্যার চেহারা নেয়নি। এমনকী সত্তরের দশকে রক্তস্নাত ছাত্র আন্দোলনকেও কখনও এই অপরাধে অভিহিত হতে হয়নি। কারণ, ছাত্র আন্দোলনের সামনে যেমন হোক একটা মতাদর্শ ছিল। এখনকার
মতো আদর্শহীন মস্তানি আর তোলাবাজির দাপট ছিল না। ষাট-সত্তরের ছাত্র আন্দোলনের সাথে আজকের এই বহিরাগত গুন্ডাদের সহায়তায় বলদর্পী আন্দোলনের গুণগত পার্থক্য এখানেই।
শাসক দলের কেউ কেউ সবংকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছেন। কিন্তু এটা কোনও মতেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজ্য জুড়ে যে মস্তানরাজ চলেছে, সেখানে গুন্ডা-মস্তানরা জানে যে, শাসকের বরাভয় থাকায় তাদের দমন করার কেউ নেই। সবং তার অনিবার্য ফলশ্রুতি। একের পর এক ঘটনাকে ‘ছোট্ট ঘটনা’, ‘সাজানো ঘটনা’ বা ‘দামাল ছেলেদের দুষ্টুমি’ বলে যে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, সবং তারই পরিণাম।
মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাটির নিন্দা করলেও শেষমেষ ‘এতে ছাত্র পরিষদ ইউনিয়ন ছিল’, এই যুক্তিতে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হামলাকারীদের আড়াল করতে লেগে পড়েছেন। এর পরিণতিতে আরও অনেক সবং অনিবার্য হবে। তাই আশু প্রতিরোধ প্রয়োজন। শিক্ষায়তনে ও ছাত্র আন্দোলনে বহিরাগত মস্তানদের গা-জোয়ারি হস্তক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ছাত্রদের সাথে রাজ্যের সকল গণতান্ত্রিক মানুষকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।
যাদবপুরের ঘটনায় আমি বলেছিলাম যে, যত ক্ষণ বিতর্ক ছাত্রদের মধ্যে সীমিত থাকে, তত ক্ষণ তা শিক্ষায়তনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাতে হস্তক্ষেপ করার দায় আর কারও নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে শিক্ষায়তনে বহিরাগত হস্তক্ষেপ ঘটে, তখন তা শুধু ছাত্রদের ব্যাপার থাকে না। বরং সকল গণতান্ত্রিক মানুষের মাথা ঘামানোর ব্যাপার হয়ে ওঠে। সবং আজ সেই দাবি নিয়েই হাজির হয়েছে।