ঝাড়গ্রাম শহরে গাছ রক্ষায় আবেদন। নিজস্ব চিত্র
আদিবাসীদের কাজে লাগিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের আরাবাড়ি বনাঞ্চল রক্ষা করেছিলেন বনাধিকারিক অজিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আরাবাড়ি মডেল বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃত। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরেই বনভূমির পরিমাণ কমছে। এই জেলায় বনাঞ্চল রয়েছে ৮৩৯ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে মেদিনীপুর ডিভিশনে ৪৭১ বর্গ কিলোমিটার, খড়্গপুরে ৯৯ বর্গ কিলোমিটার এবং রূপনারায়ণ ডিভিশনে ২৬৯ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি রয়েছে। জঙ্গলমহলের আর এক জেলা ঝাড়গ্রামের বনভূমি প্রায় ৯৫,১০৩ হেক্টরের। বনভূমির পরিমাণ কমছে এখানেও।
কী কারণে কমছে? পরিবেশ বজায় রেখে উন্নয়নের জন্য সওয়াল এখন সারা বিশ্বেই। কিন্তু ঝাড়গ্রামে সরকারি ভবন, পরিকাঠামো উন্নয়ন, জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য গত কয়েক বছরে প্রায় তিন হাজার হেক্টর বনভূমি কমেছে বলে পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ। এক সময়ে বেলপাহাড়ি এলাকায় জঙ্গল ধ্বংস করে তসর চাষের অভিযোগের প্রমাণও মিলেছিল। অসাধু কাঠ ব্যবসায়ীরা গাছ কেটে পাচার করত। বছর দশেক আগে জঙ্গলমহলের অশান্তি পর্বে অবরোধ-আন্দোলনের নামে ঝাড়গ্রাম জেলার এলাকা থেকেই প্রায় ২২ হাজার গাছ কেটে লোপাটের অভিযোগ উঠেছিল মাওবাদী ও তাদের সঙ্গীসাথীদের বিরুদ্ধে। আবার ঝাড়গ্রাম শহরের ভাস্করকাটা এলাকায় প্রতি দিনই বনভূমি দখল করে বাড়িঘর হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রামের ধারাবাহিক সৌন্দর্যহানি দেখেছেন মণিকা মজুমদার। ঝাড়গ্রামের এই প্রবীণ বাসিন্দা বললেন, ‘‘১৯৬২ সাল থেকে ঝাড়গ্রামে আছি। তখনও ঝাড়গ্রাম শহর পুর এলাকা হয়নি। ওই সময়ে রাস্তার দু’পাশে ঘন শালগাছের সারি ছিল। এখন সে সব উধাও। শহরের প্রাণকেন্দ্র রবীন্দ্রপার্কে কয়েক হাজার শালগাছ দেখেছি। এখন রবীন্দ্রপার্কে হাতেগোনা শালগাছ।’’ সমীর মজুমদার অবসরপ্রাপ্ত বনাধিকারিক। তিনি বললেন, ‘‘জঙ্গলমহলের অশান্তিপর্বের সময়ে রাস্তা অবরোধের জন্য বহু গাছ কাটা হয়েছিল। এখনও উন্নয়নের প্রয়োজনে অনেক গাছ কাটা পড়েছে। বনআইন অনুযায়ী পর্যাপ্ত বিকল্প গাছ রোপণ করা হচ্ছে না।’’ ঝাড়গ্রামের পরিবেশকর্মী সৌরভ মুদলিরও বক্তব্য, ‘‘ঝাড়গ্রামে জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য কয়েক হাজার শালগাছ কাটা পড়েছে। বনভূমির আয়তনও কমেছে। এর প্রভাব পরিবেশের উপরে পড়ছে।’’ যদিও ঝাড়গ্রামের ডিএফও বাসবরাজ হলেইচ্চির কথায়, ‘‘জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ১৫ হাজার গাছ কাটা পড়েছিল। অভাব পূরণ করতে বিকল্প জায়গায় শাল ও অন্যান্য বৃক্ষ জাতীয় ১ লক্ষ ৮০ হাজার গাছ রোপণ করা হয়েছে।’’
বনভূমি দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও চিন্তিত পরিবেশকর্মীরা। সৌরভের দাবি, ‘‘কখনও ভূমিহীন মানুষজন বনভূমিতে আস্তানা তৈরি করে বসবাস করছেন। কখনও আবার অসাধু চক্র ব্যবসায়িক স্বার্থে বনভূমি দখল করছে।’’ এই অভিযোগ মানছেন ডিএফও। তাঁর দাবি, ‘‘পুলিশের সাহায্য নিয়ে বেশ কিছু জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।’’
অরণ্যবাসীদের বনভূমির উপরে অধিকার সুরক্ষিত রেখে বন রক্ষার দাবি পরিবেশকর্মীদেরও। কিন্তু জীবন-জীবিকা আর পরিবেশ রক্ষার দায়ের দ্বন্দ্ব রয়েছে জঙ্গলমহলেও। লকডাউন-কালে ঝাড়গ্রামের বনভূমি থেকে লোপাট গিয়েছে কয়েক হাজার শালগাছ। বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা ঘরবন্দি থাকায় নজরদারির কাজটা ঠিকমতো হয়নি। বেলপাহাড়ির সরিষাবাসায় একাংশ গ্রামবাসী বিস্তীর্ণ জঙ্গল কেটে সাফ করে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। প্রায় দু’হাজার শাল ও সোনাঝুরি গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। পরে কাটা গাছগুলি বাজেয়াপ্ত করে বন দফতর। গত কয়েক মাসে ঝাড়গ্রাম বনাঞ্চলের ধবনি, কলাবনি, টিয়াকাটি, চাঁদাবিলা বনাঞ্চলের দেউলবাড়, তপোবন, নয়াগ্রাম বনাঞ্চলের কলমাপুকুরিয়া, কেশররেখা বনাঞ্চলের বালিমুন্ডার জঙ্গল থেকে গাছ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ। গত এপ্রিলে নয়াগ্রাম ব্লকের চাঁদাবিলা রেঞ্জ এলাকা থেকে কাটা শালগাছ গাড়িতে পাচার করার সময়ে হাতে নাতে ধরেছিল বন দফতর। জঙ্গল বাঁচাতে পুলিশের সাহায্য চেয়েছিল বন দফতর। ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে ঝাড়গ্রামের ১৯৭ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। যার বেশির ভাগ দুর্গম জঙ্গল। এত দীর্ঘ সীমানার সর্বত্র পুলিশ নজরদারি চালাতে পারে না। ফলে অরণ্য ঠিকঠাক রক্ষা করা যাচ্ছে না। ডিএফও (ঝাড়গ্রাম) বাসবরাজ হলেইচ্চির অবশ্য বক্তব্য, ‘‘লকডাউনের সময়ে সমস্যা হয়েছিল। তবে পুলিশ, বনরক্ষী ও বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের নিয়মিত নজরদারিতে এখন জঙ্গলে গাছ কাটার প্রবণতা ঠেকানো গিয়েছে।’’ রাজ্য সীমানা অঞ্চলে বনভূমি রক্ষায় নজরদারির বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি জেলা পুলিশের আধিকারিকদের একাংশ। তবে এক আধিকারিক জানান, বন বিভাগ চাইলে সাহায্য করা হয়।
জঙ্গলমহলে দূষণের ইতিহাসও দীর্ঘ। বেলপাহাড়িতে গোপনে পাথর খাদান চলার অভিযোগ বহু দিনের। মাইনস্ অ্যান্ড মিনারেলস অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রশাসনের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই গত কয়েক দশকে বেলপাহাড়ির অনেক ডুংরির পাথর তোলায় সবুজের চাদর কার্যত নিশ্চিহ্ন। বেআইনি পাথর খাদানের জন্য একাধিক ঝরনার উৎসমুখও বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ। ঝাড়গ্রামের জিতুশোল, মোহনপুর আর গজাশিমূলে রয়েছে তিনটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। এর মধ্যে দু’টি কারখানার কাছাকাছি লোকবসতি ও জঙ্গল। দূষণে গাছের পাতা কালো, পুকুরের জলও দূষিত হয় বলে অভিযোগ। যদিও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের সমীক্ষা অনুযায়ী, কারখানাগুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণ যথাযথ। আর অভিজ্ঞতা বলছে, ‘প্রভাবশালী’ মহলের ভয়ে দূষণ নিয়ে সরব হওয়ার সাহস দেখান না এলাকাবাসী। মুখ খুলতে চান না সংবাদমাধ্যমের কাছেও।
উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে শালগাছ কাটার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজ করে চলেছে ‘ঝাড়গ্রাম নাগরিক উদ্যোগ’ নামে একটি সংগঠন। তার আহ্বায়ক শ্রীমন্ত রাউতের কথায়, ‘‘শিল্প কারখানাগুলির দূষণের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করা হচ্ছে। বনভূমি রক্ষার দাবিতেও প্রশাসন ও বন দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। করোনা আবহে আন্দোলন কর্মসূচি করা সম্ভব না হলেও গ্রামে গ্রামে সচেতনতার কাজ চলেছে।’’
এই ঝাড়গ্রামেই প্রায় আড়াই দশক আগে প্রথম পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন পরিবেশকর্মী বিজন ষড়ঙ্গী। শালগাছ কাটার বিরুদ্ধে এবং পাথর ভাঙার কল ও সিমেন্ট কারখানার দূষণ রুখতে নেমেছিলেন পথে। চিচুরগেড়িয়ায় পাথর ভাঙার কারখানার জন্য সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে গ্রামের বেশ কিছু বাসিন্দার মৃত্যুর পরে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন মৃতদের পরিবার। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পাথর ভাঙার কল
(চলবে)