(বাঁ দিক থেকে) সৌগত রায়, প্রতিমা মণ্ডল, সাজদা আহমেদ, কালীপদ সোরেন এবং জুন মালিয়া। —সংগৃহীত।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের মতো ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিয়ানাকে ‘অস্ত্র’ করেছিল তৃণমূল। ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে ভোটের স্লোগানও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল— ‘জনগণের গর্জন, বাংলা বিরোধীদের বিসর্জন’। মঙ্গলবার সেই তৃণমূলের ২৬ জন সাংসদ শপথ নিলেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ জন বাংলার ভূমিকন্যা এবং ভূমিপুত্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় শপথ নিলেন না। অথচ হাতেগোনা কয়েক জন বাদ দিয়ে তৃণমূলের প্রায় সকলেই শপথবাক্য পাঠ করার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সংবিধানের নামে জয়ধ্বনি দিলেন। গলার শিরা ফুলিয়ে স্লোগান দিলেন ‘জয় বাংলা’!
আশ্চর্য নয় যে, বাংলার জয়ীদের শপথ নেওয়ার শেষে প্রোটেম স্পিকার ভর্তৃহরি মহতাব বলেছেন, ‘‘বাংলা ভাষা মিষ্টি ভাষা।’’
ইউসুফ পাঠান বা কীর্তি আজাদ যে বাংলায় শপথ নেবেন না, তা প্রত্যাশিত। মঙ্গলবার শপথ নেননি শত্রুঘ্ন সিন্হা (সম্ভবত কন্যার বিবাহ নিয়ে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন)। তিনি শপথ নিলেও সম্ভবত হিন্দি বা ইংরেজি ভাষাতেই নেবেন। কিন্তু কোন পাঁচ জন বাঙালি হয়েও বাংলায় শপথ নিলেন না?
দমদম থেকে চতুর্থ বার জেতা প্রবীণ রাজনীতিক সৌগত রায়ের ফোনের কলারটিউনে বাজে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কিন্তু তিনি শপথ নিলেন ইংরেজিতে। বাংলার অভিনেত্রী হয়ে মেদিনীপুর থেকে জয়ী জুন মালিয়াও বেছে নিয়েছিলেন ইংরেজি ভাষা। উলুবেড়িয়ার সাজদা আহমেদ এবং জয়নগরের প্রতিমা মণ্ডলও শপথবাক্য পাঠ করেছেন ইংরেজিতে। ঝাড়গ্রামের কালীপদ সোরেন অবশ্য সাঁওতালি ভাষায় শপথবাক্য পাঠ করেছেন। এঁদের মধ্যে প্রতিমা ছাড়া প্রত্যেকেই শপথ শেষ করেছেন মমতা এবং অভিষেকের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে। সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। গুজরাতি পাঠান হিন্দিতে শপথ নিয়ে শেষে বলেছেন, ‘‘জয় বাংলা, জয় গুজরাত।’’ আর বিহারের মিথিলার সন্তান কীর্তি বলেছেন, ‘‘জয় বাংলা, জয় মিথিলা, জয় ভারত।’’
(বাঁ দিক থেকে) কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী রায়, মহুয়া মৈত্র, সায়নী ঘোষ এবং পার্থ ভৌমিক।
সোমবার নবান্নের বৈঠকে বাংলার ‘আইডেন্টিটি’ রক্ষার বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। পুরসভা সংক্রান্ত বিষয়ে বলতে গিয়ে ‘বহিরাগতদের আগ্রাসন’ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এর পর তো বাংলায় কথা বলার লোক পাওয়া যাবে না!’’ দেখা গেল মঙ্গলবার তৃণমূলের বাঙালি সাংসদদের একাংশ বাংলায় বললেন না। আবার তুলনায় ইংরেজি ভাষায় বেশি সড়গড় মহুয়া মৈত্র শপথ নিলেন বাংলা ভাষাতেই। কয়েক মাস আগে লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত হয়েও কৃষ্ণনগর থেকে জিতে-আসা মহুয়ার জন্য হাততালির ঝড় বরাদ্দ ছিল। অভিষেক ইংরেজি এবং হিন্দির মতো বাংলাতেও সাবলীল। তিনিও বাংলাতেই শপথ নিয়েছেন। সৌগত, মহুয়া জয়ধ্বনি দিয়েছেন সংবিধানের। জয়নগরের প্রতিমা, যাদবপুরের সায়নী ঘোষ, বীরভূমের শতাব্দী রায়েরা শপথবাক্য পাঠ শেষে নিজেদের কেন্দ্রের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছেন। যেমন, প্রতিমা বলেছেন ‘‘আমি জয়নগরের সমস্ত মানুষকে নতমস্তকে প্রণাম জানাই।’’ সায়নী বলেছেন, ‘‘জয় যাদবপুর।’’ আর শতাব্দী বলেছেন, ‘‘বীরভূমের জয় হোক।’’
তবে শপথ অনুষ্ঠান মাতিয়ে দিয়েছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলায় শপথবাক্য পাঠ করা তো বটেই, কল্যাণ এক ধাপ এগিয়ে সংস্কৃতে চণ্ডীস্তোত্র পাঠ করতে শুরু করেন। লোকসভার ভিতরে শপথ অনুষ্ঠানে হাত তুলে স্লোগান দিয়ে শ্রীরামপুরের সাংসদ জনসভার মেজাজই এনে দিয়েছিলেন প্রায়। এহ বাহ্য, বিজেপির সৌমিত্র খাঁ যখন শপথ নিতে যাচ্ছেন, কল্যাণ তাঁর আসনে বসে বসেই টিপ্পনী কাটেন, ‘‘এই যে, পৃথিবীর একমাত্র লোক, যে নিজের বৌকে হারিয়েছে!’’
সৌমিত্রের কাছে পরাজিত তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী সুজাতা মণ্ডলের শপথে থাকার কথা ছিল না। থাকলে সম্ভবত তিনিও তৃণমূলের টিকিটে জয়ী মহিলা প্রার্থীদের সকলের মতো শপথ নিতেন শাড়ি পরেই। শাড়ির পাশাপাশি জুন-মহুয়ার গলায় মুক্তোর হারেও ঐক্য ছিল। পুরুষদের পোশাকে বৈচিত্র দেখা গিয়েছে। পাঠান যেমন গাঢ় নীল বন্ধ-গলা এবং ট্রাউজ়ার পরেছিলেন। কীর্তির পোশাকে ছিল সাবেকি বাঙালিয়ানা সম্পৃক্ত তসরের পাঞ্জাবি-ধুতি। গলায় মধুবনি প্রিন্টের উত্তরীয়। বেশির ভাগ পুরুষ সাংসদই পরেছিলেন পাজামা-পাঞ্জাবি। কারও কারও পাঞ্জাবির উপর শোভা পেয়েছে হাতকাটা জ্যাকেট। অভিষেকের পোশাকে অবশ্য বাহুল্য ছিল না। রোজকার মতোই গাঢ় রঙের ট্রাউজ়ার্স এবং সাদা শার্ট পরে শপথ নিয়েছেন। পোশাকে নজর কেড়েছেন ব্যারাকপুর থেকে জয়ী পার্থ ভৌমিক। সাদা শার্টের বুকপকেটের কাছে নীল দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘জয় বাংলা’। পাঠান ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও ‘ঈশ্বরের নামে’ শপথ নিয়েছেন। আবার সাজদা, আবু তাহের খানেরা শপথ নিয়েছেন ‘আল্লার নামে’।
বাংলায় ৪২টির মধ্যে ২৯টি লোকসভা আসন জিতেছে তৃণমূল। তবে মঙ্গলবার শপথ নিয়েছেন ২৬ জন। তৃণমূলের নির্বাচিতদের মধ্যে শত্রুঘ্ন ছাড়া শপথ নেননি বসিরহাটের নুরুল ইসলাম এবং ঘাটালের দীপক অধিকারী (দেব)। জানা গিয়েছে, নুরুল অসুস্থ। দেব কাজে ব্যস্ত। অন্য দিকে, বিজেপির সুকান্ত মজুমদার এবং শান্তনু ঠাকুর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী-সহ অন্যান্য মন্ত্রীর সঙ্গে সোমবারই শপথ নিয়েছেন। মঙ্গলে পদ্মশিবিরের বাকি ১০ জন শপথ নিয়েছেন। দার্জিলিঙে জয়ী রাজু বিস্তা ইংরেজিতে শপথ নিয়েছেন। আলিপুরদুয়ারের মনোজ টিগ্গা হিন্দিতে। মালদহ দক্ষিণের খগেন মুর্মু সাঁওতালিতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শপথবাক্য পাঠ করেছেন বাংলায়। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়-সহ বিজেপির বাকি সকলে পুরোপুরি বাংলাতেই শপথ নিয়েছেন। শপথ নিয়েছেন মালদহ উত্তরের কংগ্রেস সাংসদ ইশা খান চৌধুরীও। তিনি অবশ্য ইংরেজি ভাষাই বেছেছিলেন।