তেল-কই থেকে ভাপা ইলিশ। আম-শোল থেকে মৌরলার ঝালচচ্চড়ি। ম্যাজিক দেখাচ্ছে মাছ!
ঠিকঠাক বলতে গেলে, মৎস্যরসিক বাঙালির অতি প্রিয় হরেক মাছের ‘তৈরি’ পদ। যার দৌলতে মুনাফার ময়দানে শুধু হাইজাম্প নয়, একেবারে পোলভল্ট দিয়ে বসেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি সংস্থা!
এবং সাফল্যের মূল মন্ত্র— সাধ্যের মধ্যে স্বাদ পূরণ। কী রকম?
বড়ি-বেগুন দিয়ে পাবদার ঝাল হোক কিংবা ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক, চিতলের তেলঝাল বা সর্ষেবাটার ট্যাংরা— বাংলার বিভিন্ন সনাতনী মেছো পদের আস্বাদ বহু লোক উপভোগ করতে পারছেন না প্রধানত তিনটে কারণে। প্রথমত, জোগানে টান থাকায় বাজারে এমন সব মাছের দর এতই চড়া যে, ছোঁয়া দায়। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ বাড়িতে রাঁধার মতো পারদর্শী কেউ নেই। তিন, বাঙালি খানার রেস্তোরাঁয় পাওয়া গেলেও মামুলি গেরস্তের রেস্তর দৌড় সে পর্যন্ত পৌঁছয় না।
ঝোপ বুঝে এখানেই কোপ মেরেছে রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগম (স্টেট ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড)। মাছের নানা বাহারি পদ তারা বাঙালির পাতে তুলে দিচ্ছে রেস্তোরাঁর তুলনায় অনেক সস্তায়। তাতেই বাজিমাত। শুধু মাছের ‘আইটেম’ বেচে ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে নিগম লাভ করেছিল তিন লক্ষ টাকা। ২০১৫-১৬য় এক লাফে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ লক্ষে!
রকেটসদৃশ এ হেন উত্থানের ভিত অবশ্য গাঁথা হয়ে গিয়েছিল কয়েক বছর আগে, যখন বাঙালির চিরন্তন মাছের পদগুলোকে সস্তায় আমজনতার হাতের গোড়ায় হাজির করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬৫-তে গড়ে ওঠা নিগম প্রথমে মাছ চাষ ও কাঁচা মাছ বিক্রি করত। মমতার নির্দেশে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে তারা নলবনের রেস্তোরাঁ, নিকো পার্ক, ক্যাপ্টেন ভেড়ি, বিকাশ ভবনের স্টল ও নানা মেলা-উৎসবে মাছের আইটেম বেচতে শুরু করে। প্রথম বছরে লাভ ছিল দেড় লাখ টাকা। পরের বছরে দ্বিগুণ— তিন লাখ। আর গত অর্থবর্ষে মুনাফার বৃদ্ধি তো চোদ্দো গুণ ছাড়িয়ে গিয়েছে!
সাফল্যের রহস্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিগমকর্তারা জানাচ্ছেন, মৎস্য দফতরেরই আর সংস্থা ‘বেনফিশ’-এর ব্যর্থতায় শিক্ষা নিয়ে তাঁরা সাবধানে পা ফেলেছেন। একদা বেনফিশের ফ্রাই, ব্যাটার ফ্রাই, ফিঙ্গার, রোল ইত্যাদির মারকাটারি চাহিদা দেখেছে কলকাতা। ময়দানের বইমেলায় গিয়ে বই না কিনুন, বিস্তর মানুষ বেনফিশের স্টলে লাইন দিতে ভুলতেন না। মোড়ে মোড়ে দাঁড়ানো বেনফিশের গাড়িতে ফ্রাই, ফিঙ্গার গরমাগরম ভেজে পরিবেশন করা হতো। সে গৌরব অস্তমিত। বেনফিশের খাবার এখন মুখে তোলা যায় না বলে অভিযোগ।
কেন, তা খুঁড়ে দেখেছেন মৎস্য-কর্তারা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ— বেনফিশ টাটকা মাছ দিতে পারছে না, দক্ষ রাঁধুনিও বাড়ন্ত। ‘‘নিগমের যাতে একই অবস্থা না হয়, সে জন্য আমরা গোড়া থেকে সতর্ক ছিলাম।’’— বলছেন এক আধিকারিক। তাই নিগম নিজস্ব জলাশয় থেকে মাছ ধরছে। তা দিয়ে মনকাড়া পদ রাঁধার তালিম দেওয়া হচ্ছে রাঁধুনিদের। বাঙালি রান্নার জন্য প্রসিদ্ধ, রাজ্য জুড়ে ছড়ানো এক রেস্তোরাঁ-চেনে তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে।
পাশাপাশি এক-একটা শহরের খদ্দেরদের টাটকা মাছের স্বাদে তৃপ্ত করার তাগিদে নিকটবর্তী উৎস ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। যেমন, বর্ধমানে নিগমের নিজস্ব জলাশয় যমুনাদিঘির মাছ ধরে-রেঁধে গাড়িতে করে বিক্রি করা হবে বর্ধমান, আসানসোল, দুর্গাপুর, বোলপুরে।
অগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে সল্টলেক, রাজারহাট, গড়িয়াহাট, শ্যামবাজারে গাড়িতে করে ইলিশের রকমারি পদ নিগম বিক্রি করছে। নিগমের এমডি সৌম্যজিৎ রায় বলেন, ‘‘রেস্তোরাঁর চেয়ে নিগমের গাড়িতে সস্তায় ও টাটকা মাছ মিলছে।’’ রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলছেন, ‘‘শীঘ্রই নবান্নে চালু হবে নিগমের নতুন রেস্তোরাঁ, ওখানে মিলবে মাছের বহু লোভনীয় পদ। তা ছাড়া, প্রতিটি জেলা শহরে গাড়ি নিয়ে রান্না করা মাছ বিক্রি হবে।’’
নিগমের দৃষ্টান্তে বেনফিশ-ও উজ্জীবিত। বেনফিশের এমডি বিধানচন্দ্র রায় বলেন, ‘‘বরফের মাছ দিয়ে রান্না হচ্ছিল। স্বাদ মার খাচ্ছিল। এ বার নিগমের মতো আমরাও গা়ড়িতে টাটকা মাছের আইটেম রাখব।’’ মন্ত্রী চন্দ্রনাথবাবুর ঘোষণা— ‘‘বেনফিশে দক্ষ রাঁধুনি নিয়োগ হবে। দরকারে তাদেরও ট্রেনিং হবে।’’
মাছের ম্যাজিক শুধু নিগমকে বিপুল লাভই দিচ্ছে না। তার ছোঁয়ায় চনমনে হয়ে উঠছে প্রায় ঝিমিয়ে পড়া আর এক প্রতিষ্ঠানও।