দুর্ঘটনাস্থল পেরোচ্ছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। — নিজস্ব চিত্র।
রাত ৯টা ২৯। দুপুর পর্যন্ত হিসেব ছিল সব ঠিকঠাক চললে ৭টা বাজতে ৫ থেকে ৭টার মধ্যে পৌঁছব। কিন্তু ট্রেন আড়াই ঘণ্টা লেট। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে আলোর ঝলক দেখে বুঝতে পারলাম, এটাই বাহানগা। স্টেশনে ঢোকার আগে লেভেল ক্রসিংটা পেরোতেই রেললাইনের দু’পাশে অস্থায়ী সব আলো বাঁধা। এখানেই পাঁচ দিন আগে অন্ধকার নেমে এসেছে শয়ে শয়ে মানুষের, শয়ে শয়ে পরিবারের জীবনে।
আমাদের ট্রেন এখন সেই জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছে। এখানেই গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল। এখন কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি, আমাদের বাঁ দিকে পড়ে আছে সেই করমণ্ডলের বগিগুলো। তার পাশ দিয়ে আবার চলে যাচ্ছে এই করমণ্ডল এক্সপ্রেস। আমরা যার যাত্রী। এখনও কি ওখানে কেউ আটকে থাকতে পারে? ঢিপ করে ওঠা বুক পরক্ষণেই বলল, না, তা কী করে সম্ভব? সব নিশ্চয়ই তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখা হয়েছে। আবার মনে হল, ওই ভাবে দুমড়ে যাওয়া কোনও কামরায় উদ্ধারের সব চেষ্টার পরও কি কেউ থেকে যেতে পারে? জীবিতদের চক্ষুর অন্তরালে? থাকলেও বেঁচে থাকা নিশ্চয়ই সম্ভব না! সম্ভব না হলেই বোধহয় ভাল।
আস্তে, খুবই আস্তে এই জায়গাটা বুধবারের করমণ্ডল এক্সপ্রেস পেরোল। বাহানগা বাজার স্টেশন ছুঁয়ে যখন আমাদের ট্রেনটা পেরিয়ে গেল, তখন রাত ৯টা ৩৩। লেভেল ক্রসিং থেকে এই পর্যন্ত— গোটা পর্বে ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় মেরেকেটে ২০ কিমি।
শালিমার স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলাম দুপুর দুপুর। দুর্ঘটনার পাঁচ দিন পর বুধবার ফের করমণ্ডল এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা নির্ধারিত সময় বিকেল ৩টে ২০-তে। শেষ পর্যন্ত ছাড়ল মিনিট ছয়েক দেরি করে। তখনই চোখ বন্ধ করে কপালে হাতজোড় করে সামনে রাখা গোপালমূর্তিকে বিড়বিড় করে কী সব যেন বলেছিলেন লক্ষ্মী দাস সরকার। হুগলির কোন্নগর থেকে চেন্নাই যাচ্ছেন মেজমেয়ের কাছে। করমণ্ডলের চাকা একটু গড়াতেই সামান্য ছন্দপতন। বাতানুকূল কামরা ঠান্ডা হচ্ছে না। এসি খারাপ নাকি! সাঁতরাগাছি পৌঁছতেই প্ল্যাটফর্মে থাকা টিটি-কে বলা হল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই কামরায় হাজির এক রেলকর্মী। তত ক্ষণে ট্রেন যদিও সাঁতরাগাছি ছেড়ে দিয়েছে। মেচেদার কাছাকাছি গিয়ে কামরা ঠান্ডা হতে শুরু করল। দাঁড়ানোর কথা নয়। কিন্তু মেচেদা স্টেশনে কয়েক মিনিটের জন্য থেমে গেল ট্রেন। পথে আরও বেশ কয়েক বার এমন ভাবেই দাঁড়িয়েছে বুধবারের করমণ্ডল।
করমণ্ডল থেকে মোবাইলবন্দি দুর্ঘটনাস্থল। —নিজস্ব চিত্র।
যে চালক এবং সহকারী শালিমার থেকে এই করমণ্ডলকে নিয়ে আসছিলেন, খড়্গপুরে তাঁরা নেমে গেলেন। সেখান থেকে চালকের আসনে বসলেন এসসি দাস। সঙ্গে সহকারী পি টাকুয়া। চালকের কেবিনে গোটাটা পর্যবেক্ষণ করছেন চিফ লোকো ইনস্পেকটর অনুপ মান্না। সে দিনের করমণ্ডলেও থাকার কথা ছিল অনুপের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ডিউটি রস্টার বদলে যায়। করমণ্ডলের বদলে তিনি শতাব্দী নিয়ে গিয়েছিলেন। বুধবার খড়্গপুর থেকে করমণ্ডল নিয়ে যাত্রা শুরুর আগে চালকের কেবিনে বসে অনুপ বললেন, ‘‘যেতে তো হবেই। ডিউটি ইজ় ডিউটি।’’
পাঁচ দিন বন্ধ ছিল আপ করমণ্ডল। ওই রুটের অধিকাংশ ট্রেনই এই ক’দিন চলেনি। চলা সম্ভব ছিল না। ফলে এখন ঠাসা ভিড়। ইঞ্জিনের পরের জেনারেল কামরা দু’টিতে তিল ধারণের জায়গা নেই। এমনকি, তার পরের স্লিপার কোচগুলির কোনও কোনওটাতে এক একটি আসনে চার-পাঁচ জন করে বসে। ক্যানিং থেকে চেন্নাই যাচ্ছেন গোবিন্দ দাস। গত শুক্রবার থেকে টিভিতে যা যা দেখেছেন, তা আর মনে করতেই চান না তিনি। বললেন, ‘‘এ সব নিয়ে ভাবতে নেই। পেটের দায়। এ সব ভেবে বাড়িতে বসে থাকলে তো আর পেট চলবে না!’’
ট্রেন তখন সবে খড়্গপুর ছেড়েছে। অনেকেই রাতের খাওয়া সেরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। — নিজস্ব চিত্র।
একই কথা কাঞ্চন শর্মার। বিহারে বাড়ি। সপরিবার যাচ্ছেন চেন্নাই। স্বামী বদলি হয়েছেন সম্প্রতি সেখানে। দুই সন্তান ও স্বামী-সহ তাঁদের চার জনের করমণ্ডল এক্সপ্রেসেই টিকিট ছিল মঙ্গলবারের। কিন্তু ট্রেন বাতিল হওয়ায় তৎকাল টিকিট কেটে বুধবারের করমণ্ডল ধরেছেন। বি-৩ কামরায় বসে হাসতে হাসতেই বললেন, ‘‘ভয় পেয়ে লাভ কী! যেতে তো হবেই। ঘুরতে যাচ্ছি এমনটা তো নয় যে, বাতিল করব! ওঁকে (স্বামী) তো গিয়ে জয়েন করতে হবে।’’
জেনারেল কামরাতে চেপে বিশাখাপত্তনম যাচ্ছেন পার্বতী মণ্ডল। সেখানে রংমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। ভগবানপুরের বাড়িতে এসেছিলেন কয়েক দিনের জন্য। স্লিপার ক্লাসে টিকিট পাননি বলেই বুধবার শালিমার থেকে জেনারেলের টিকিট কেটে চড়েছেন। সঙ্গের দুটো ব্যাগ ঝুলিয়েছেন মাথার উপর ঘুরতে থাকা পাখার জালিতে। কামরাটা এতটাই ভিড়ে ঠাসা যে, এই গরমে বাইরের হাওয়াটুকুও আসছে না ভাল করে। আর ট্রেনের পাখাতেও জোর নেই। বালেশ্বরে দাঁড়িয়ে থাকা করমণ্ডলের জানলা থেকে কোনও ক্রমে মুখটা বাড়িয়ে গলদঘর্ম পার্বতী বলেছিলেন, ‘‘বিশাখাপত্তনম যাব। ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানেই তো প্রায় ২ ঘণ্টা লেট রয়েছে ট্রেনটা। কী যে আছে কপালে!’’
চেন্নাইয়ের পথে সপরিবার কাঞ্চন শর্মা। —নিজস্ব চিত্র।
খড়্গপুর ঢোকার কথা ছিল ঠিক বিকেল ৫টায়। ঢুকল ২৬ মিনিট দেরিতে। ৫ মিনিট দাঁড়িয়েই ছাড়ার কথা। ছাড়ল ৩৬ মিনিট পর। এর পর বেলদা, জলেশ্বর, হলদিপাড়া… দাঁড়ানোর কথা না-থাকা এই সব স্টেশনে অন্তত ১০ মিনিট করে দাঁড়িয়ে বালেশ্বর পৌঁছই সন্ধ্যা ৭টা ৫১-য়। গত শুক্রবার এর ঘণ্টাখানেক আগেই বাহানগার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল আপ করমণ্ডল। বালেশ্বরে প্রায় ৩৪ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকল ট্রেন। ছাড়ার পর খান্তাপাড়া, পানপানায় দাঁড়িয়ে তার পর বাহানগা বাজার। বালেশ্বর ছাড়ার পর থেকেই যাত্রীদের মধ্যে উচাটন শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে অনেকেই শুয়ে-বসে ছিলেন। হঠাৎই কে যেন কামরার ও প্রান্ত থেকে বলে উঠেছিলেন, ‘‘ঢুকছে।’’
সঙ্গে সঙ্গে বাঁ দিকের জানলাগুলোর দিকে সরে গেলেন প্রায় সকলে। কয়েক জন তো দরজা খুলে দাঁড়িয়েও পড়লেন। বিদ্যুতের খুঁটি, লাইনপাড়ের গাছে লাগানো হয়েছে অস্থায়ী আলো। এখনও কাজ চলছে। রেলকর্মীরা করমণ্ডলের ছবি তুলছেন মোবাইলে। ট্রেন থেকেও তোলা হচ্ছে তাঁদের ছবি। উল্টেপাল্টে থাকা সেই দিনকার করমণ্ডলের বগিগুলো পড়ে রয়েছে। সবুজ রঙের কাপড়ের সামিয়ানায় ঢাকা। ছবি উঠছে তাদেরও। আলোতে ভাল করেই নজরে আসে দুর্ঘটনার জায়গাটা। গত শুক্রবার গভীর রাত থেকে দিন তিনেকের জন্য এই জায়গাটাই তো ছিল গোটা দেশের ‘হট স্পট’।
গোপালের মূর্তি সঙ্গে নিয়ে কোন্নগরের লক্ষ্মী দাস সরকার। —নিজস্ব চিত্র।
পেরিয়ে গেলাম জায়গাটা। ট্রেনের গতিবেগ কত? ঠিকঠাক ঠাওর করা না গেলেও, ঘণ্টায় কুড়ি কিলোমিটারের বেশি হবে না। ওই গতিতেই বাহানগা বাজার পেরিয়ে গেল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। প্ল্যাটফর্মের ধুলোও উড়ল না! এত ক্ষণের চঞ্চল মন আবার এই করমণ্ডল এক্সপ্রেসটার মতোই ধীরগতির হয়ে এল। সে দিন করমণ্ডলের গতি ছিল ১২৮! মুহূর্তটা ভাবার চেষ্টা করছিলাম। কেন হল এমন? কী ভাবে হল? কিসের দোষে? তদন্ত চলছে। জানা যাবে। সত্যিই জানা যাবে কি? এমন কত কিছুই তো নতুন খবরে চাপা পড়ে হারিয়ে যায়। এমন কত কিছুরই তো তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়ে না। বা পড়লেও...। ভেবে দেখলাম, গত শুক্র বা শনিবার করমণ্ডল দুর্ঘটনা নিয়ে যে হইচই, প্রশ্ন, ক্ষোভ, সব অনেকটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। এমনই হয়। ট্রেনটা আবার গতি বাড়াতেই ঝট করে মনে পড়ে গেল, এর পরের স্টেশন ভদ্রক। আমাদের টিকিট ওই পর্যন্তই। নামতে হবে।