ফিরোজা বিবি
খাতা দেখে গান গেয়ো না, উল্টে পাতা যেতেও পারে! একদা সতর্ক করেছিলেন এক নাগরিক কবিয়াল। খাতার লেখা ফুরিয়ে গেলে সুর কেমন অন্য পথে ছুটতে পারে, তার নমুনা শুক্রবার দেখল রাজ্য বিধানসভা!
স্বরাষ্ট্র বাজেটের উপরে বিধানসভায় বক্তৃতা করছিলেন ফিরোজা বিবি। নন্দীগ্রামে সেই ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিচালনায় নিহত ‘শহিদের মা’ হিসাবে তৃণমূলে তাঁর আলাদা কদর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পরিষদীয় সচিব করে ফিরোজার পরিবারের আত্মত্যাগের ‘স্বীকৃতি’ দিয়েছেন। সেই ফিরোজাই বিচার চেয়ে বসলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে!
বিধানসভার বিতর্কে শাসক দলের হয়ে বক্তৃতা করলে এমনিতেই অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। সরকার পক্ষ পাছে অস্বস্তিতে পড়ে, এমন যাবতীয় প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে যেতে হয়। তার উপরে বিশেষ বলিয়ে-কইয়ে নন, এমন বিধায়কদের জন্য শাসক দলের পরিষদীয় নেতৃত্বই সিলেবাস বেঁধে দেন। ফিরোজার জন্যও সেই ব্যবস্থাই ছিল। কিন্তু গোল বাধল সিলেবাস ফুরিয়ে যেতেই!
মমতা সরকারের চার বছরে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার কেমন উন্নতি হয়েছে, রীতি মেনে তার বর্ণনাই দিচ্ছিলেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক। বিরোধীদের আক্রমণ নস্যাৎ করতে ফিরোজা বোঝাচ্ছিলেন, পুলিশ কী ভাবে বেআইনি অস্ত্র, জাল মদ বাজেয়াপ্ত করছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রাজ্যে নতুন মহিলা থানা হয়েছে, সেই তথ্যেরও উল্লেখ করেছিলেন। নন্দীগ্রামে সেই পুলিশি গুলিচালনার সময়ে কেমন অত্যাচার হয়েছিল, বামেদের দুষ্কৃতী বাহিনী কেমন তাণ্ডব চালিয়েছিল, সে সবের খতিয়ানও শোনা যাচ্ছিল। এ সবই ফিরোজার কাছে খাতায় লেখাও ছিল। কিন্তু লেখা ফুরিয়ে গেল তাঁর জন্য নির্ধারিত ৭ মিনিট ফুরনোর আগেই!
তার পর?
ফিরোজা যত ক্ষণ লিখিত বয়ান আউড়ে যাচ্ছিলেন, বিধানসভায় কারও মনোযোগই প্রায় তাঁর দিকে ছিল না। এ বার হঠাৎই বিরোধী বামফ্রন্টের বেঞ্চ থেকে শুরু হল হইহই! বাম বিধায়কেরা ট্রেজারি বেঞ্চে মন্ত্রীদের ইশারা করে বললেন, ‘‘শুনুন, শুনুন! আপনাদের নন্দীগ্রাম কী বলছে!’’
ফিরোজা তখন বলে চলেছেন, ‘‘নন্দীগ্রামে এখনও পর্যন্ত আমরা বিচার পাইনি। সন্তান হারিয়ে আমরা হাহাকার করছি! কিন্তু ২০০৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনও সুবিচার পেলাম না!’’ তাঁর নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিট দেড়েক নাগাড়ে বিচারের দাবিই জানিয়ে গেলেন ফিরোজা! শাসক দলের বিধায়কের মুখে এমন মন্তব্য শুনে ট্রেজারি বেঞ্চ তখন দৃশ্যতই অস্বস্তিতে! মন্ত্রী-বিধায়কদের মুখ থমথমে। ফিরোজার পাশের আসনে হলদিয়ার তৃণমূল বিধায়ক শিউলি সাহা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ফিরোজাকে থেমে যাওয়ার জন্যও ইশারা করলেন। কিন্তু থামা দূর অস্ত্, মাথার ঘোমটায় মুখ প্রায় ঢেকে নিয়ে ফিরোজা তখন আগল ভেঙেছেন!
অনেকটা এই রকমই ঘটেছিল আশির দশকের বিধানসভায়। অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুরের অধুনালুপ্ত চোপরা কেন্দ্র থেকে জিতে আসা সিপিএম বিধায়ক বাচ্চা মুন্সি প্রায় নিস্তরঙ্গ বিধানসভা অধিবেশনের উল্লেখ-পর্বে হঠাৎ বলে বসেছিলেন, ‘‘সব শালো চোর!’’
কেন? বিধায়কের অভিযোগ ছিল, তাঁর এলাকায় নলকূপ বসাতে গিয়ে লাট্টুর মতো ঘুরপাক খাচ্ছেন তিনি। ‘পঞ্চায়েতবাবু’ থেকে উপরতলার নেতা, কেউ তাঁর কথায় কানই দেন না। খাটো পায়জামা আর কাঁধে গামছা
ফেলা বাচ্চাবাবুর উপলব্ধি ছিল, ‘‘টাকা ছাড়া কাজ মেলে না! সবাই আসলে চোর!’’ মুহূর্তে সতর্ক হল শাসক বেঞ্চের কান! স্পিকার কোনওক্রমে লালবাতি জ্বেলে বাচ্চা মুন্সির ভাষণে ইতি টানলেন। কিন্তু কথাগুলি থেকে গেল।
এ দিন কোন ক্ষোভ থেকে মমতার কাছে বিচার চাইলেন ‘শহিদের মা’? তৃণমূলের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনায় অভিযুক্ত তৎকালীন পুলিশ অফিসারদের কয়েক জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার জন্য সিবিআই আবেদন করলেও মমতার রাজ্য সরকার তাতে সম্মতি দেয়নি। বরং এই সংক্রান্ত একটি মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সেই সময়ের অভিযুক্ত অফিসারদের অনেকেই মমতার আমলে ভাল পোস্টিং পেয়েছেন। এ সব নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই ক্ষোভ আছে। তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও এক বার ওই অফিসারদের শাস্তি চেয়ে কলকাতায় সিবিআই দফতরের সামনে ধর্না দিয়েছিলেন। পুরনো সেই ক্ষোভই এ দিন ফিরোজার কথায় বেরিয়ে এসেছে বলে দলের একাংশের ধারণা।
স্বরাষ্ট্র বাজেটের জন্য এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিধানসভায় উপস্থিত থাকলেও ফিরোজার বক্তৃতার সময় সভায় ছিলেন না। জবাবি বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী বাম আমলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি প্রসঙ্গে নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গ প্রত্যাশিত ভাবেই তুলেছিলেন। কিন্তু ফিরোজার অভিযোগের কোনও জবাব তাঁর মুখে শোনা যায়নি।
বক্তৃতা শেষ করার পরেই দলের এক বিধায়ক অবশ্য প্রায় আর্তনাদের সুরেই ফিরোজাকে বলেন, ‘‘এখনও বিচার পাইনি, এটা বলতে গেলেন কেন?’’ ফিরোজাও পরে বুঝতে পেরেছেন, তিনি লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করে ফেলেছেন।
তাই সভার বাইরে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘আগের মুখ্যমন্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে ভুল করে এটা বলে ফেলেছি!’’ তাঁর কথায়, ‘‘২০০৯ সালে বিধায়ক হয়ে বিধানসভায় এসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে নন্দীগ্রাম নিয়ে এই অভিযোগ জানিয়েছিলাম। সেই কথাটাই মনে পড়ে গিয়েছিল।’’ কিন্তু ২০০৯ সালের পরে ২০১৫— পুরনো কথা মনে প়ড়ল ছ’বছর পরে? রাজ্যের এক মন্ত্রীর সরস মন্তব্য, ‘‘আরও কিছু মনে পড়েনি ভাগ্যিস!’’