সভা-যুদ্ধের ফাইনালে জয়ী বিজেপি

তৃণমূলের একাধিপত্যে অবশেষে আঘাত হানল বিজেপি! ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সেই ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই থেকে একাই সভা করে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন তিনি কংগ্রেসে। নিজের দল গড়ার পরেও শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাস্তা জুড়ে সভা করার ব্যাপারে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ ছিল না। পুলিশ-প্রশাসনের অনুমতির তোয়াক্কা না-করেই প্রায় প্রতি বছর সেখানে দলের শহিদ দিবস পালন করেছেন তিনি। আদালতের নির্দেশে পুরসভার অনুমতি আদায় করে আজ, রবিবার সেখানে সভা করতে চলেছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৩৯
Share:

রণে ভঙ্গ প্রশাসনের। আজ অমিত শাহের সভা ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনেই। শনিবার বিকেলে মঞ্চ বাঁধার তদারকিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

তৃণমূলের একাধিপত্যে অবশেষে আঘাত হানল বিজেপি!

Advertisement

ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সেই ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই থেকে একাই সভা করে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন তিনি কংগ্রেসে। নিজের দল গড়ার পরেও শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাস্তা জুড়ে সভা করার ব্যাপারে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ ছিল না। পুলিশ-প্রশাসনের অনুমতির তোয়াক্কা না-করেই প্রায় প্রতি বছর সেখানে দলের শহিদ দিবস পালন করেছেন তিনি। আদালতের নির্দেশে পুরসভার অনুমতি আদায় করে আজ, রবিবার সেখানে সভা করতে চলেছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ।

শুক্রবারই বিজেপির সভার পথ অনেকটা প্রশস্ত করে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি দেবাংশু বসাক তাঁর রায়ে বলেছিলেন, দমকল ও পুরসভার শর্ত মেনে মঞ্চ তৈরি করে সভা করতে পারবে বিজেপি। সেই রায় শুনে ঘনিষ্ঠ মহলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়ে সভা ঠেকানোর শেষ চেষ্টার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় প্রশাসনিক মহলে।

Advertisement

পুরসভা সূত্রের খবর, রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন পুরসভার মুখ্য লিগাল অফিসার। শনিবার, হাইকোর্ট বন্ধ থাকলেও জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ শুনানির জন্য আর্জি জানানো হয় প্রধান বিচারপতির দফতরে। কিন্তু সেই আবেদন গ্রাহ্য হয়নি বলেই পুরসভার এক আমলা জানান। ফলে সভা ঠেকানোর চেষ্টা ছেড়ে তার প্রস্তুতিতে নেমে পড়ে পুরসভা।

পুরসভার এই পিছু হটা নিয়ে এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে দলীয় সভায় যোগ দিতে যাওয়ায় এ দিন তিনি পুরসভায় আসেননি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে শোভনবাবু বলেন, “আমি কলকাতার বাইরে রয়েছি। কিছু জানি না।” যদিও পুরসভা সূত্রে বলা হচ্ছে, গোটা বিষয়টিই মেয়রকে জানানো হয়েছে।

সভা নিয়ে অহেতুক জেদাজেদি করে কেন বিজেপির সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে তৃণমূলের একটা অংশের অসন্তোষ গোড়া থেকেই ছিল। কিন্তু আপত্তি যে হেতু খোদ মমতার, তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। তৃণমূলের এই অংশটি বলছে, ডিভিশন বেঞ্চে গেলেও যে রায় পুরসভার পক্ষে যেত, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর সেটা হলে সরকার এবং দলের আরও মুখ পুড়ত।

তৃণমূলের অন্য একটি অংশের আবার বক্তব্য, ডিভিশন বেঞ্চ যদি ধর্মতলায় সভা করার অনুমতি না দিত, তা হলেও দলের বিপদ হতো। কারণ সে ক্ষেত্রে তৃণমূলও ভবিষ্যতে আর সেখানে সভা করতে পারত না। বস্তুত, বিচারপতি বসাকও শুক্রবার সওয়ালের সময় সরকারি আইনজীবীকে বলেছিলেন, “ওই জায়গায় আর কোনও দিন সভা করা হবে না বলে রাজ্য সরকার যদি জানিয়ে দেয়, তা হলে এই মামলা আমি খারিজ করে দেব।”

অথচ, ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভা করাটা যে তৃণমূলের সম্মানের প্রশ্ন, সেটা কবুল করছেন দলের সব স্তরের নেতারাই। বিজেপির সভার আবেদন খারিজ করার সময় শোভনবাবু বলেছিলেন, “তৃণমূলের সভার সঙ্গে অন্যদের কোনও তুলনা হয় না। ওখানে দলের ১৩ জন শহিদ হয়েছিলেন। জায়গাটা আমাদের কাছে পূণ্যভূমি। সেখানে প্রতি বছর ২১ জুলাই তৃণমূল সভা করে। অন্য দিন নয়। তাই অন্য কাউকে সেখানে সভা করতে দেওয়া হয় না।” এখন আদালত ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সব রকম সভা বন্ধ করার নির্দেশ দিলে বড় ক্ষতি হবে তৃণমূলেরই। এই সমস্ত আশঙ্কার কথা ভেবেই আদালতের নির্দেশ মানাই সাব্যস্ত হয়। নবান্ন থেকে পুরসভায় নির্দেশ আসে, বিচারপতি বসাকের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আদালতে তদ্বির করার দরকার নেই।

ফলে শনিবার সকালে সভাস্থল সরেজমিন ঘুরে দেখার পরে বিজেপি-কে সভা করার অনুমতি দিয়ে দেন পুরসভার যুগ্ম কমিশনার সৃষ্টিধর সাঁতরা এবং দমকলের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। পুরসভার যুগ্ম কমিশনার তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন, হাইকোটের নির্দেশ মাথায় রেখে পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ মতো মঞ্চে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার শর্তে ওই অনুমতি দেওয়া হল। তবে এত দিন বেঁকে বসার পরে শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে সভার অনুমতি দিতে বাধ্য হওয়ায় আখেরে যে দলের মুখ পুড়ল, তা কবুল করছেন পুরসভার তৃণমূল মেয়র পারিষদেরাই। কেউ কেউ এই ঘটনার দায় চাপাচ্ছেন মেয়রের ঘাড়ে। অন্যরা আবার বলছেন, “মেয়র তো নিজের ইচ্ছেয় বাধা দেননি। নেত্রীর নির্দেশ ছিল বলেই তাঁকে অমন অবস্থান নিতে হয়েছিল।” লড়াইয়ের জমি এক ইঞ্চিও না-ছেড়ে ধর্মতলায় সভার অনুমতি আদায় করার পরে স্বাভাবিক ভাবেই শাসক দলকে কটাক্ষ করেছে বিজেপি। দলের বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, “তৃণমূল কর্মীদের অনেকেই এখন স্বৈরতন্ত্রী নেত্রীর শাসন থেকে মুক্তি চাইছেন। এটা বুঝে ভয় পেয়েই তৃণমূল আমাদের সভা আটকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে, তাতে পুরসভা ও দমকলের ছাড়পত্র দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।”

এ দিন বিকেলেই সভামঞ্চের প্রস্তুতির কাজ দেখতে যান বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক এবং রাজ্যের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। রাতে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করেন দলীয় নেতারা। অমিত শাহের সঙ্গে কে কে মঞ্চে থাকবেন, কে কে বক্তৃতা করবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঠিক হয়েছে, সিদ্ধার্থনাথ এবং রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ ছাড়াও রাজ্যের দুই বিজেপি সাংসদ এবং এক বিধায়ক বক্তৃতা করবেন। মঞ্চে থাকবেন সব স্তর ও শাখা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

বাধা টপকে

২২ জুলাই: সভার অনুমতি চেয়ে লালবাজারে আর্জি বিজেপির। পরে আরও দু’বার চিঠি।

১৮ নভেম্বর: অনুমতি না পেয়ে হাইকোর্টে মামলা। বিজেপির সঙ্গে বৈঠকের নির্দেশ সিপি-কে।

২০ নভেম্বর: সিপি-র সঙ্গে বিজেপি প্রতিনিধিদের বৈঠক।

২১ নভেম্বর: সভা করতে পুরসভা, দমকলের অনুমতি লাগবে বললেন সিপি।

২৪ নভেম্বর: ফের হাইকোর্টে মামলা দায়ের বিজেপির।

২৫ নভেম্বর: বিচারপতির নির্দেশ, পুরসভা ও দমকলের কাছে আবেদন জানাবে বিজেপি।

২৭ নভেম্বর: পুরসভা-দমকল বলল, আবেদনপত্র ত্রুটিপূর্ণ।

২৮ নভেম্বর: ফের মামলা দায়ের। শর্তসাপেক্ষে সভার অনুমতি বিচারপতির।

২৯ নভেম্বর: সকাল থেকে মঞ্চ তৈরির তোড়জোড়। পরিদর্শনের পরে মিলল আনুষ্ঠানিক অনুমতি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement