মহাদেব মল্লিক
ঘরের কোণে ছোট চৌকি পাতা। তার উপরেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি পরা এক প্রৌঢ়ের বিশাল কাটআউট। নীচে জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ-সহ লেখা, ‘নাটা মল্লিক। ইন্ডিয়াজ় ওনলি হ্যাংম্যান লিভজ় অন দ্য এজ’!
কাটআউট দেখিয়ে মাঝবয়সি মহাদেব মল্লিক বললেন, ‘‘বাবা বলতেন, মন না চাইলে ফাঁসির কাজ করবি না। মনে রাখবি, সমাজের কাজ করছিস।’’
কয়েক ঘণ্টা আগেই ফাঁসি হয়েছে দিল্লির নির্ভয়া গণধর্ষণ-কাণ্ডের দোষীদের। শুক্রবার সকালে সেই প্রসঙ্গেই কথা বলতে গিয়ে নাটা মল্লিকের ছোট ছেলে মহাদেব জানালেন, নিজের হাতে এই ফাঁসি দেওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। অপেক্ষাও করেছিলেন কিছু দিন। তাঁর কথায়, ‘‘ফাঁসুড়ে হয়ে ফাঁসি দিতে দুঃখ হয় এই ভেবে যে, এক জনের জীবন নিলাম! কিন্তু যখন মনে হয়, এমন কাজ করল কেন যে ফাঁসি দিতে হল, তখন রাগ হয়। তবে নির্ভয়া-কাণ্ডের দোষীদের নিজের হাতে ফাঁসি দিতে একটুও দুঃখ পেতাম না। নিজে হাতে ওদের ফাঁসি দেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল।’’ সেই সঙ্গেই একাধিক তারিখ বদল নিয়ে মহাদেবের মন্তব্য, ‘‘দোষীদের ক্ষমাভিক্ষার কোন কোন রাস্তা খোলা আছে, সেই সব দেখে নিয়ে ফাঁসির তারিখ ঠিক করা ভাল। বারবার যখন তারিখ বদল হচ্ছিল, নির্ভয়ার মায়ের মনে খারাপ প্রভাব পড়ছিল। তবে আজ শুধু ওই মহিলাই নন, আমার মনে হয় গোটা দেশ আজ শান্তি পেয়েছে।’’
ফাঁসির প্রসঙ্গেই মহাদেব ফিরে যান বাবা নাটা মল্লিক এবং তাঁদের পরিবারের প্রসঙ্গে। ২০০৯ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয় নাটা মল্লিকের। বছর পঞ্চান্নের মহাদেব এখন কলকাতা পুরসভার কর্মী। দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসার। নাটা মল্লিকের বড় ছেলে তারক পুরকর্মী হিসেবে অবসর নিয়েছেন। তারক না করলেও ১৯৮৭-২০০৪ সাল পর্যন্ত কলকাতায় তিনটি ফাঁসির আদেশের প্রেক্ষিতে মহাদেবই ছিলেন বাবার মূল সহকারী। মহাদেব বলেন, ‘‘দাদু শিবলাল মল্লিক ফাঁসুড়ে ছিলেন। আমার প্রপিতামহ মিস্ত্রিলাল ইংরেজ জমানায় ফাঁসির কাজে যুক্ত ছিলেন। বিহার থেকে কলকাতায় চলে আসার পরেও দাদু ফাঁসির কাজ করেছেন। সেই সূত্রেই বাবা। বাবার পরে ফাঁসির কাজ আমিই করব ভেবেছিলাম।’’ কিন্তু ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের পরে আর ফাঁসি দেওয়া হয়নি এ শহরে।
কেমন ভাবে হয় ফাঁসির প্রস্তুতি? মহাদেব বলতে থাকেন, ‘‘জেলের মধ্যেই মহড়া চলে। যাঁকে ফাঁসি দেওয়া হবে তাঁর যা ওজন, তার থেকেও ২৫ কিলোগ্রাম বেশি ওজনের বালির বস্তা দড়ির সঙ্গে ঝোলানো হয়। ১৯৮৭ সালে আদালতের একটি ফাঁসির নির্দেশের পরে বাবার সঙ্গে প্রথম ওই মহড়ায় যাই। পরে অবশ্য সেই আদেশ স্থগিত হয়ে যায়।’’ ১৯৯১ সালে সুকুমার বর্মণ ও কার্তিক শীলের ফাঁসিতেও নাটা মল্লিকের সহকারী ছিলেন মহাদেব। তিনি বলেন, ‘‘আগের রাতেই জেলে পৌঁছে দড়িতে ভাল করে ঘি মাখিয়ে ট্রায়াল দেওয়া লিভারের সঙ্গে সেটি লাগিয়ে দেওয়া হয়। লিভারে লাগানো দড়ি ফাঁসির মঞ্চের সামনের গর্ত দিয়ে নীচের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে ইংরেজির ইউ অক্ষরের মতো পাক খাইয়ে ফের উপরে তুলে একটা আংটার সঙ্গে লাগানো থাকে। জেল সুপার রুমাল ফেললেই লিভার টেনে দিতে হয়। এর পরেই সরাসরি ওই নীচের ঘরে চলে যায় দেহটি।’’
নির্ভয়া-কাণ্ডের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে মহাদেবের মন্তব্য, ‘‘এই ফাঁসির ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই এই সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল! কিছু দিন পরে সবটা জানতে পারব।’’ কিছু ক্ষণ চুপ থেকে মহাদেব বলেন, ‘‘ওই সময়ে কত জন কত কথা বলে জানেন! কার্তিক শীলেরা যেমন বাবাকে বলেছিলেন, ‘দেখে নেব। তোর পরিবারকে শেষ করে দেব।’ ধনঞ্জয় আবার বলেছিলেন, ‘ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।’ পরিবর্তে বাবা ওঁদের শুধু বলেছিলেন, ‘অপরাধ নেবেন না’।’’
কয়েক মিনিট চুপ থেকে মহাদেব বললেন, ‘‘অপরাধ নেবেন না। এখন মনে হয়, কিছু অপরাধের এমন শাস্তিই দরকার।’’