‘শুধু কালো ধোঁয়া, আওয়াজ, আতঙ্ক, পাহাড় থেকে নামব কী করে!’

আমাদের হোটেলে তো বটেই, গোটা দার্জিলিঙে থাকা পর্যটকদের এখন একটাই ভয়, পাহাড় থেকে নীচে নামবে কী ভাবে? পরিস্থিতি ক্রমেই মনে হচ্ছে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।

Advertisement

অন্বেষা দত্ত

দার্জিলিং শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৭ ১৬:৪১
Share:

ধুন্ধুমারের পর। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

চারপাশটা কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। যত দূর চোখ যাচ্ছে, শুধুই কালো কালো পাকানো কুণ্ডলী। তার মধ্যেই অনবরত বোমা পড়ার মতো আওয়াজ। হতে পারে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটছে। আবার বোমার শব্দও হতে পারে। গুলি কি! না, হোটেলের এই ঘরে বসে কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে, শুধু আতঙ্কের মাত্রা আর উত্তেজনাটা বেড়েই চলেছে। বাচ্চা নিয়ে সমতলে ফিরতে পারব তো ঠিকঠাক?

Advertisement

গত পরশু সন্ধেবেলা দার্জিলিং পৌঁছেছি। উঠেছি কেভেন্টার’স-এর ঠিক উল্টো দিকে গাঁধী রোডের একটা হোটেলে। আমাদের ঘর থেকে কেভেন্টার’স-এর ছাদটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানকার নীল রঙের ছাতাগুলো বা চেয়ার-টেবল— সবই উল্টেপাল্টে রাখা। দলে দলে স্কুল পড়ুয়া দৌড়ে আসছে কেভেন্টার’স-এর সামনের রাস্তা দিয়ে। বাচ্চাটাকে কোলে জড়িয়ে মাঝে মাঝেই বারান্দায় ছুটে যাচ্ছি। অনবরত অ্যাম্বুল্যান্সের হুটারের আওয়াজ আসছে। একটা জোরালো চিত্কার পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে আমাদের হোটেলের ঘরে ঢুকে পড়ছে। আর ছোট্ট শাক্য বার বার কেঁপে উঠছে!


ম্যালের রাস্তায় আতঙ্কিত পড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।

Advertisement

আমাদের হোটেলে তো বটেই, গোটা দার্জিলিঙে থাকা পর্যটকদের এখন একটাই চিন্তা, পাহাড় থেকে নীচে নামবেন কী ভাবে? পরিস্থিতি ক্রমেই মনে হচ্ছে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রায় ১০ হাজার পর্যটক এই মুহূর্তে দার্জিলিঙে আটকে রয়েছেন। আমাদের এক বন্ধুর আজ রাতেই ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি (এনজেপি) স্টেশন থেকে। গণ্ডগোল শুরু হওয়ার আগেই ওরা আজ বেরিয়ে পড়েছিল। কিন্তু একটু আগেই ফোনে খবর নিয়ে জানলাম, রোহিনীর রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওরা পাঙ্খাবাড়ির রাস্তা ধরেছিল। সেটাও একটু আগে আটকে দেওয়া হয়েছে। আমরা এখন দল বেঁধে একসঙ্গে পাহাড় ছাড়তে চাইছি। কিন্তু, হোটেল থেকেই তো বেরোতে পারছি না। গাড়িও পাওয়া যাবে কি! কিছুই বুঝতে পারছি না!

আরও খবর
মোর্চার জঙ্গি বিক্ষোভে পাহাড়ে আগুন-লাঠি-গ্যাস, সেনা ডাকল রাজ্য

অথচ সকালটা একেবারে অন্য রকম ছিল। দার্জিলিং স্টেশন থেকে টয় ট্রেনে চড়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম ঘুম। সাত সকালের পাহাড়ি রাস্তায় মোর্চার অনেকগুলি ছোট মিছিল দেখেছিলাম। তবে, সবই ছিল স্বাভাবিক। ফেরার পথেও কোনও অস্বাভাবিকতা নজরে পড়েনি। দার্জিলিং স্টেশন থেকে হেঁটেই ফিরছিলাম। কিছু কেনাকাটার ছিল। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ চকবাজার যাই। যে দোকানে ছিলাম, তার মালিককে কে যেন হঠাত্ এসে নেপালি ভাষায় কিছু বলে গেলেন। তার পরেই দোকানি আমাদের বলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি করুন। দোকান বন্ধ করে দিতে হবে।’’ আমাদের হয়েই গিয়েছিল। বেরিয়ে আসি। এর পর নাথমুল’স-এ চা কিনতে যাই। তত ক্ষণে ওদের সব ক’টা শাটার নেমে গিয়েছে। একটা দরজা খোলা ছিল। সেখান থেকেই কোনও রকমে অল্প একটু চা কিনেই হোটেলে ফিরে আসি। দুপুরের খাওয়া অবধি সব ঠিক ছিল। হঠাত্ করেই হোটেলে কে যেন খবর দিল, গণ্ডগোল বেধে গিয়েছে। তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত এক সেকেন্ডের জন্য স্বস্তি পাইনি। এখন তো শুনছি সেনা নামবে পাহাড়ে!


দার্জিলিঙের রাস্তায় জ্বলছে গাড়ি।—নিজস্ব চিত্র।

ম্যালের দিক থেকেও প্রচণ্ড চিত্কার শুনতে পাচ্ছি। কী যে হচ্ছে। এইমাত্র হোটেলের এক জন খবর দিলেন, মোর্চা নাকি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্‌ধ ডেকেছে। কী ভাবে পাহাড় থেকে নামব! ভাবলেই এই ঠান্ডার মধ্যে ঘামে ভিজে যাচ্ছি। পাহাড়ের আবহাওয়ার মতো, পরিস্থিতিও যে এত দ্রুত পাল্টে যাবে বুঝতে পারিনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement