ফাইল ছবি
কোভিড-বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে বাকি বিশ্বের মতোই লাফিয়ে বাড়ছে না আয়ের অঙ্ক। অথচ ‘টানাটানির সংসারে’ খরচ দ্রুত বেড়েছে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’র মতো এক গুচ্ছ কল্যাণ প্রকল্পের হাত ধরে। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মানছেন, এই পরিস্থিতিতে এতটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখা যে, অর্থ জোগানো কঠিন হচ্ছে পরিকাঠামো-সহ নানা ক্ষেত্রে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, এই ‘কঠিন সময়ে’ যত দিক থেকে এবং যত বেশি করে সম্ভব কেন্দ্রীয় তহবিলের টাকা আনা ও তার সদ্ব্যবহারের উপরে জোর দিচ্ছে প্রশাসনের শীর্ষমহল।
সূত্রের খবর, লিখিত ভাবে না হলেও, প্রশাসনের শীর্ষমহল থেকে প্রায় নিয়মিত প্রতি দফতরকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, শুধু রাজ্য বাজেটের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে, যেখানে যে ধরনের কেন্দ্রীয় আর্থিক সুবিধা পাওয়া সম্ভব, তা কাজে লাগাতে হবে। রাজ্যে চালু যে সমস্ত প্রকল্পে কেন্দ্রের বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব, সেগুলিতে তা আনতে হবে। আবার রাজ্যে না থাকা অন্য যে সমস্ত প্রকল্পে কেন্দ্র অর্থ বরাদ্দ করে রেখেছে, তার সম্পর্কযুক্ত প্রকল্প এখানে চালু করে বন্দোবস্ত করতে হবে দিল্লি থেকে টাকা পাওয়ার।
শুধু তা-ই নয়, এই লক্ষ্যে প্রায় সব সংশ্লিষ্ট দফতর দ্রুত কেন্দ্রের পাবলিক ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (পিএফএমএস) সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা শুরু করেছে বলেও সূত্রের খবর। প্রশাসনিক কর্তারা জানাচ্ছেন, এই পোর্টালের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পে দেওয়া টাকার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখে কেন্দ্র। বহু ক্ষেত্রে উপভোক্তার অ্যাকাউন্টে টাকা সরাসরি পৌঁছেও দেওয়া হয় এর মারফত। বর্তমান নিয়মে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পেতে তাই পিএফএমএসে অন্তর্ভুক্তি জরুরি।
প্রসঙ্গত, প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আগে বরাদ্দ হওয়া টাকা খরচ নিয়ে কেন্দ্রের অনুসন্ধানের কার্যত বিরোধী ছিল রাজ্য। কিন্তু সেই অবস্থানে অনড় থাকলে, এখন বরাদ্দ টাকা পাওয়াই শক্ত। তাই কিছুটা সরে আসা হচ্ছে সেই অবস্থান থেকে। আগে প্রকল্পের টাকা পেতে কিছু দফতর যোগ দিয়েছিল পিএফএমএসে। এখন প্রয়োজনে সব দফতরকেই কার্যত তার ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। এক প্রশাসনিক কর্তার কথায়, “কেন্দ্র চাইছে, তাদের বরাদ্দের পুরোটাই খরচ হোক কেন্দ্রীয় ভাবে। এতে হিসাব কষা এবং নজরদারি দু’টিই সম্ভব। বেশ কিছু দফতর ইতিমধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অর্থ দফতর কেন্দ্রের ওই ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত হলেই তা সম্পূর্ণ হবে।’’ একই সঙ্গে তাঁর আক্ষেপ, ‘‘কেন্দ্রে রাজ্যের অফিসারদের উপস্থিতি বেশি থাকলে, টাকা আনায় এত বেগ পেতে হত না।”
কেন এই তৎপরতা? চলতি আর্থিক বছরের (২০২২-২৩) বাজেট প্রস্তাবে সব মিলিয়ে রাজ্যের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ ৯১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সামাজিক খাতে সম্ভাব্য খরচ প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকা। সুদ-সহ ধার শোধের জন্য তুলে রাখতে হবে ৭০ হাজার কোটি। এ ছাড়াও রয়েছে সরকারি কর্মী, শিক্ষক প্রমুখদের বেতন-পেনশন এবং সরকার চালানোর অন্যান্য খরচ। এই সমস্ত বাদ দিয়ে যে টাকা পড়ে থাকে, তাতে সমস্ত দফতরের বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা জোগাতে হবে। অর্থ জোগাতে হবে বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পে। তার উপরে, রাজস্ব আদায় লাফিয়ে বাড়ার মতো পরিস্থিতি এখনও অর্থনীতিতে নেই। জিএসটি ক্ষতিপূরণের মেয়াদও শেষ হচ্ছে আগামী জুনে।
অথচ তৃণমূল তৃতীয় বার সরকারে এসে চালু করেছে লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ এক গুচ্ছ নতুন কল্যাণ প্রকল্প। পরিধি বাড়ছে পুরনো প্রকল্পগুলিরও। সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রায় ১.৭৫ কোটি উপভোক্তাকে এ বছর আর্থিক সহায়তা দিতেই খরচ হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এর দরুন শহর ও গ্রামে পরিকাঠামো প্রকল্পে টাকা জোগানোয় টান পড়ছে। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকেরাও মনে করছেন, এতে সব চেয়ে বেশি ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা পরিকাঠামো ক্ষেত্রে। অথচ রাজ্য সরকার শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যার অন্যতম প্রাথমিক শর্ত পরিকাঠামো উন্নয়ন। এই সমস্ত মাথায় রেখেই রাজ্য বাজেটের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ার বদলে কেন্দ্রীয় আর্থিক সহায়তার বিষয়টি সম্ভবত এখন বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
রাজ্যের অর্থ-কর্তাদের অনেকে অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে যে অর্থ পাওয়ার কথা, তার পুরোটা রাজ্য পায় না। কেন্দ্রের কাছে বকেয়া এখনই যেমন প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। তাই কেন্দ্র যেখানে যা আর্থিক সুবিধা ধার্য করে, তার যথাসম্ভব ব্যবহার যুক্তিযু্ক্ত। অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, “রাজ্যের থেকেই করের টাকা সংগ্রহ করে কেন্দ্র!... ফলে কেন্দ্রের অর্থ নয়, বলা উচিত রাজ্যের মানুষের দেয় অর্থই ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।” এক অর্থ-কর্তার দাবি, “রাজ্যের অর্থনীতি সঠিক খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী দিনে রাজ্যে আর্থিক বৃদ্ধির হার ১২% ছাপিয়ে যেতে পারে।”